হাসপাতাল জীবন বরাবরই কৌতূহলী করেছে লেখকদের। হাসপাতালে আছে জীবন-মৃত্যুর লড়াই, আছে আশা-নিরাশার নাগরদোলা, আছে নাটকীয়তা। হাসপাতাল কারো জন্য হয়ে উঠেছে নিরাময়ের পবিত্র তীর্থ, কারো জন্য বিভীষিকার অন্ধকূপ। বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত অনেক গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে হাসপাতাল-জীবনকে কেন্দ্র করে। হাসপাতাল আধুনিক সমাজের অন্যতম জটিল একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। ফলে সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানীরাও হাসপাতাল বিষয়ে কৌতূহলী হয়েছেন। হাসপাতালের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মাত্রাগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁরা। শাহাদুজ্জামান একাধারে চিকিৎসা-নৃবিজ্ঞানী এবং কথাসাহিত্যিক। তিনি বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওপর একটি নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণার ভিত্তিতে লেখা এই বইতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের একটি হাসপাতালের ভেতরকার বিচিত্র বাস্তব চিত্র।
Shahaduz Zaman (Bangla: শাহাদুজ্জামান) is a Medical Anthropologist, currently working with Newcastle University, UK. He writes short stories, novels, and non-fiction. He has published 25 books, and his debut collection ‘Koyekti Bihbol Galpa’ won the Mowla Brothers Literary Award in 1996. He also won Bangla Academy Literary Award in 2016.
কেন যে বইটা এতোদিন পড়বো পড়বো করেও পড়িনি! বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে যারা পা রেখেছেন তারাই বইটার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাবেন।
২০১২ সালে আমাদের সমাজকর্ম বিভাগ থেকে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের জন্য এক সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট এ পাঠানো হয়েছিলো। মানসিক রোগীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কাউন্সিলিং। ডাক্তাররা রাউন্ডে এসে একেক রোগীর সামনে সর্বোচ্চ এক মিনিট দাঁড়াতেন। সর্বোচ্চ! "কী অবস্থা? কী ওষুধ চলছে? ওষুধ খাওয়াতে থাকেন।ঠিক হয়ে যাবে।" ব্যস! রোগী দেখা শেষ।রোগের কী অবস্থা, রোগীর কী প্রয়োজন কিছুই রোগী বা তার আত্মীয়রা জিগ্যেস করার সুযোগ পেতেন না।কাউন্সিলিং এর তো প্রশ্নই আসছে না। কেউ কিছু জিগ্যেস করতে গেলে ডাক্তাররা যেন শুনতেই পেতেন না!বাড়তি প্রশ্ন করতে গেলে ধমক তো আছেই।আমি এক রোগীর আত্মীয়কে দেখেছি, যিনি রোগীকে কবে বাড়িতে নিতে পারবেন এই প্রশ্নটাই করতে পারেননি দুই সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করেও!! আমি এতো অবাক আর ব্যথিত হয়েছিলাম! কিন্তু এটাই বাংলাদেশ।
নিজের পিএইচডি থিসিসের জন্য বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের সার্বিক চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছিলেন শাহাদুজ্জামান। সেই থিসিসটাই গল্পাকারে উপস্থাপন করেছেন তিনি। রোগী, রোগীর আত্মীয়স্বজন, ওয়ার্ডবয়, ঝাড়ুদার, দারোয়ান, নার্স, ডাক্তার প্রত্যেকের কাজ ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। কী অবস্থায় পড়ে রোগীরা(বিশেষত গরিব) হাসপাতালে আসে, এখানের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে তাদের কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়, রোগীর আত্মীয়দের হাসপাতালের লোকজন উপদ্রব বিবেচনা করলেও কীভাবে তাদের সাহায্য ছাড়া রোগীকে আরোগ্য করা সম্ভব হয় না, প্রত্যেকে কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা কীভাবে প্রতিনিয়ত চুরি করে ও একজোট হয়ে হাসপাতাল জিম্মি করে রাখে, নার্সরা কীভাবে সামাজিক প্রতিকূলতা পার হয়ে এখানে কাজ করে ও রোগীদের সাথে ন্যূনতম সম্পর্কও রাখতে চায় না, ডাক্তাররা কীভাবে সারাক্ষণ অধস্তনদের ধমকের ওপর রাখে- নিজেদের আধিপত্য দেখাতে ব্যস্ত থাকে, আবার তারাই কীভাবে অল্প টাকায় উদ্ভাবনশীল উপায়ে রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, কীভাবে অত্যল্প স্টাফ ও অপ্রতুল বাজেট নিয়ে কাজ করে অতিকষ্টে রোগীদের সেবা দিতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হয় প্রশাসনের - সবই অত্যন্ত প্রাণবন্ত ভাষায় উপস্থাপন করেছেন নৃবিজ্ঞানী শাহাদুজ্জামান। এ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ!
লেখকের প্রধান একটি গুণ নির্মোহতা। কাউকেই দোষারোপ করেননি। শুধু যা পর্যবেক্ষণ করেছেন তা-ই তুলে ধরেছেন। বইটা বছর বিশেক আগে লেখা। এখন পর্যবেক্ষণ করলে শাহাদুজ্জামান নতুন আরো অনেক ভয়ংকর তথ্য পেতেন। সেসব গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।
নৃতত্ত্ব নিয়ে আমার সেরকম জ্ঞান নেই। তাই নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি কেমন হয়েছে বা কত ভালো হয়েছে সেটা বলা আমার কম্মো নয়। তবে একটি গবেষণা গ্রন্থ হিসাবে সমগ্র বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা খন্ডচিত্র মেডিকেল বিষয়ে খুব একটা জ্ঞান না রাখা সাধারণ মানুষের কাছে বেশ গোছানো এবং সহজবোধ্য ভাবেই তুলে ধরতে লেখক সক্ষম হয়েছেন বলেই বলতে হয়।
আমাদের মত দেশে স্বাস্থ্যসেবার পেশায় নিয়োজিত হওয়া যে খুব একটা স্বস্তিদায়ক আর সম্মানজনক ব্যপার তা বলবার কোনই সুযোগ নেই। সে শুধু ডাক্তারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, ডাক্তারের অধস্তন অথবা হাসপাতালে কর্মরত নার্স, ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার সহ সকলের ক্ষেত্রেই কমবেশি প্রযোজ্য। রোগীরাও যে এখানে খুব একটা সমাদৃত সেটাও বলার কোন কারণ নেই। এই প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষের দুরাবস্থার যে চিত্র লেখক তার এই গবেষণায় তুলে এনেছেন সেগুলো নিয়ে আলাদা করে লিখতে গেলেও এই রিভিউর কলেবর অনেক অনেক বড় আকার ধারণ করবে।
তার চেয়ে ব্যক্তিগত কিছু কথা শেয়ার করে যাই। ছাত্র জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে এটেন্ডেন্ট হিসাবে রাত্রিযাপনের এবং রোগী দেখতে যাবার সুযোগ হয়েছিল। যতবারই গিয়েছি ততবারই আমার মনে হয়েছে যে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের অথবা অনার্স পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাজীবনের অন্ততপক্ষে তিনমাস (একমাস লিখতে চাইসিলাম, কিন্তু একমাস কিছু বোঝার আগেই শেষ হয়ে যাবে।) তার নিজ নিজ এলাকার সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার বা নার্সদের সহকারী হিসাবে সার্ভিস দেয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। তাতে হাসপাতালের লোকবল সংকটের কিছুটা পরিত্রাণ যেমন হতে পারে, তেমনি একই সাথে সাধারণ মানুষের (বিশেষত শিক্ষিত গোষ্ঠির) মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে কর্মরত মানুষ এবং অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠির প্রতি সহমর্মিতার জায়গা তৈরি হবার সম্ভাবনা রয়েছে৷
যে পরিমান সংকট আর অব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের চিকিৎসার সাথে নিয়োজিত পেশাজীবীরা বাকিদের সেবা দিয়ে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাতে তাদেরকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। রোগীদের সাথে দূর্ব্যবহার আমার কাছে সে হিসাবে স্বাভাবিকই মনে হইসে। এত ঝামেলা মাথায় নিয়ে বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই মাথা ঠিক রাখা সম্ভব না। যদিও আসলে ডাক্তারদের ইকটু ভালো ব্যবহারেই রোগীদের অনেক খানি রোগ সেরে যায়, তবুও বলতে হয় যে ডাক্তাররাও তো আসলে মানুষ। ডাক্তারদের রেগুলার ইন্টার্ভালে সাইকোলজিকাল কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা থাকলে ভালো হত! যদিও সে আশা আসলে মরীচিকা! পেটে ভাত নাই তার আবার ঘি খাবার স্বপ্ন!
হাসপাতালে চালানো একটি গবেষণাকে উপজীব্য করে লেখা বইটিতে হাসপাতালকে কল্পনা করা হয়েছে একটি ছোট বাংলাদেশ হিসেবে। হাসপাতালের একটি ওয়ার্ড, অর্থোপেডিক ওয়ার্ড ব্যবহৃত হয়েছে গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে। সেখানকার পরিবেশ, রোগী, ওয়ার্ডবয়, নার্স, ডাক্তার-প্রতিজনের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে চেয়েছেন লেখক। কথা বলেছেন প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে। যেমন নিচের লেখাটি একজন রোগীর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ।
"যেমন একজন রোগী, তিনি কলেজের ছাত্র, আমাকে বললেন কি করে তিনি স্টাফদের চেনেন। ' যদিও যে ঝাড়ু দেয় সে ট্রলীও ঠেলে কিন্তু এ ট্রলী ঠেলে সে কখনো ঝাড়ু দেয় না। সুতরাং ঝাড়ুদারকে চেনা যায়। নার্সদের তো চেনাই যায়ই কারণ তারা সাদা শাড়ি পরে। পুরুষ নার্সরাও সাদা শার্ট পরে তাই তাদের চেনা যায়। ডাক্তাররা তো সাদা কোট পরে না, তাই তাদের অনেক সময় চেনা যায় না। তবে ভাবসাব দেখলে বোঝা যায় কে ডাক্তার। ডাক্তারদের মধ্যে সবসময় বস বস ভাব। তারা এসে সবাইকে বকাবকি করে। যে যত বড় ডাক্তার তার গলা তত চড়া। সব চেয়ে বড় যে ডাক্তার সে সবাইকে সবচেয়ে বেশি বকাবকি করে। উনি এলে সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে। উনি ঘুরে ঘুরে সব রোগী দেখে আর সবাই তার পিছে পিছে হাঁটে। একজন হুজুর ডাক্তার আছে, যে তার এ্যাসিস্ট্যান্ট। আর ছোট ডাক্তারও আছে যারা ডাক্তারী শিখতেছে। বড় ডাক্তার তাদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে এবং না পারলে বকা দেয়।'
একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়- শাহাদুজ্জামান (২০০৪), মাওলা ব্রাদার্স"
একজন ডাক্তার হিসেবে এই পর্যবেক্ষণটি যে সত্যি আমি নিজেও জানি। কিন্তু হাসপাতালের নানা ঘটনার আড়ালে কেবল এই বকাবকি-ধমকাধমকি দিয়েই সবাইকে বিচার করলে বিষয়টি ভুল হবে। এই বকাবকি করা ডাক্তাররাই নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্��ি দিয়ে সীমিত সম্পদের মধ্যেও সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন গরীব রোগীদের জন্য পুওর ফান্ডের ব্যবস্থা করতে বা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ কোম্পানির কাছ থেকে ব্যক্তিগত উপহার না নিয়ে গোটা ওয়ার্ডের সুবিধার জন্য একটা দরকারি কিছু ব্যবস্থা করতে।
ওয়ার্ডবয়দের আচরণ, তাদের সামাজিক অবস্থান এবং মনস্তত্ত্ব এসেছে লেখায়। এসেছে নার্স হিসেবে মেয়েদের অবমূল্যায়নের দৃশ্যপট। ডাক্তারদের পেশাগত হতাশা এবং রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে হতাশা এবং কবিরাজি চিকিৎসায় আস্থার কথা। এখানে একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ যে কেন রোগীরা হাতুড়ে বা কবিরাজের কাছে যায়। এর পেছনে আর্থসামাজিক অবস্থানটা খুব জরুরি। রোগীরা ডাক্তারদের কাছে সমভাবাপন্ন কোন আচরণ পায় না, কিন্তু কবিরাজ বা পল্লীচিকিৎসকদের কাছে তারা বন্ধুর মতো আচরণ পায়, মন খুলে কথা বলতে পারে। যার ফলে দেখা যায় কবিরাজদের ভুল চিকিৎসায় তেমন প্রতিবাদ না হলেও ডাক্তারদের প্রায়ই অকারণে ভুল চিকিৎসার অপবাদে হেনস্থা হতে হয়।
সত্যি বলত, শাহাদুজ্জামানের এই লেখাটি বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক-পারিবারিক অবস্থার একটা চিত্র। যেখানে একটি হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের নানান চরিত্রের মাধ্যমে ঐতিহাসিক এবং নৃতাত্ত্বিক কারণসমূহ উঠে এসেছে যে কেন এখানককার মানুষ এমন। চমৎকার একটি বই। আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন।
গতকাল অফিসে আসা আর যাওয়ার পথে পড়ে শেষ করে ফেলেছি এটা। কামলাসূত্রে হোক, লেখকের সঙ্গে সাম্প্রতিক সরাসরি মোলাকাতসূত্রে হোক, 'অইত্যান্ত' চমৎকার লেগেছে। :) কাল-পরশু ছুটি, অসংখ্য কাজ এবং অকাজের ফাঁকে গুছিয়ে বিস্তারিত পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার ইচ্ছে রাখি।
হাসপাতাল, যেখানে সব কিছুই অনিশ্চিত। কেবল মৃত্যুই নিশ্চিত।
একটি হাসপাতাল রোগীর কাছে বিভীষিকাময় অন্ধকূপ, আশা-নিরাশার লড়াই কেন্দ্র, জীবন-মৃত্যুর লড়াই আর আরোগ্য লাভের শেষ ভরসা। ডাক্তারের কাছে ল্যাবরেটরি, আর সেবা দান কেন্দ্র। নার্সদের কাছে রোগীর পরিচর্যাকেন্দ্র। এছাড়াও রোগীর আত্মীয়-স্বজন, ওয়ার্ড বয়, দারোয়ান সহ নানান ব্যক্তির কাছে রয়েছে হাসপাতাল কে দেখার ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।
কিন্তু, একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে শাহাদুজ্জামান একটি হাসপাতালকে দেখেন একটি ক্ষুদ্র বাংলাদেশ হিসেবে। বাংলাদেশের মতই একটি হাসপাতালে আছে নিজস্ব সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি, অবহেলা, অসচেতনতা। আছে আশা-নিরাশা, কর্মব্যস্ততা, উদ্ভাবনী সক্ষমতা। আছে টিকে থাকা। এমনি এক স্বতন্ত্র বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে শাহাদুজ্জামানের "একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়'' নামক গবেষণা গ্রন্থে।
শাহাদুজ্জামান কে আমরা চিনি একজন সাহিত্যিক হিসেবে। সাহিত্যের জগতের বাইরেও তার একটা পরিচয় আছে। তিনি একজন চিকিৎসক। আর তার পেশাগত কারণে, PhD থিসিস করেছেন আমস্টাডার্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তবে, ক্লিনিক্যাল কোন বিষয়ে থিসিস না করে, শাহাদুজ্জামান বেছে নিয়েছেন 'নৃতত্ত্ব' কে। ফলে, একটি হাসপাতালে গবেষণাটি পরিচালিত হলেও তা ক্লিনিক্যাল বিষয়ে না হয়ে, হয়েছে নৃতাত্ত্বিক।
মূল গবেষণার থিসিস পেপারের কিছু একান্ত একাডেমিক আর বিস্তারির টিকা, রেফারেন্স অংশটি বাদ দিয়ে গবেষণা সাহিত্যের মত করে বাংলায় অনুবাদ করেছেন এই গ্রন্থটি। তবুও, কিছুটা কাঠখোট্টা আর একাডেমিক প্যাটানেই রয়ে গেছে বইটি।
বইটি আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত, প্রতিটি অধ্যায়েই তিনি হাসপাতালের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। দেখিয়েছেন কিভাবে একটি হাসপাতাল, একটি ক্ষুদ্র বাংলাদেশেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
এখানে বলে রাখা ভাল, মূল গবেষণাটি পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হলেও রিসার্জ ফিল্ড টি ছিল বাংলাদেশের একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। গোপনীয়তা রক্ষার্থে মেডিকেল কলেজটির নাম প্রকাশ করেন নি লেখক। বিভিন্ন চরিত্রর ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেছেন ছদ্মনাম। আর, পশ্চিমা দেশের বাইরের কোন হাসপাতালে করা এটাই সম্ভাবত কোন প্রথম নৃতাত্ত্বিক গবেষণা। ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নীতিগত দিক সহ নানান দিকে আমাদের হাসপাতাল গুলো পশ্চিমা দেশের হাসপাতালের পুরোপুরি বিপরীতে অবস্থান করছে।
মূল বইয়ের অধ্যায় গুলিতে একটি হাসপাতালের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে-
ক. এক সকালে অর্থোপেডিক ওয়ার্ড এই অধ্যায়ে মূলত উঠে এসেছে হাসপাতালের আদি কাহিনী। কীভাবে হাসপাতালের উৎপত্তি, কীভাবে ধর্মের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল। এছাড়াও, এক সময়ে যে হাসপাতাল ছিল শুধুমাত্র দরিদ্রদের জন্য, সেটা কীভাবে হলো সর্বজনীন। এছাড়াও, শাহাদুজ্জামানের কিছু ব্যক্তিগত তথ্য প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে।
খ. রোগী: বিধ্বস্ত হাড়, বিধ্বস্ত জীবন নৃতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য শাহাদুজ্জামান যে ওয়ার্ড টি বেছে নিয়েছেন, সেটা একটি 'অর্থোপেডিক' ওয়ার্ড। আর, এই চ্যাপ্টারে মূলত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাদের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাবেই দেখিয়েখেন পেশা, ধর্ম, লিঙ্গ, সামাজিক অবস্থানের ভিত্তি কীভাবে কাজ করে এই অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের রোগীদের ক্ষেত্রে। সমাজের খেটে খাওয়া দিনমজুর পুরুষেরাই মূলত অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের রোগী।
গ. রোগীর আত্মীয়-স্বজন : অকূলের কূল সরকারি হাসপাতালে সাধারনত সমাজের অর্থনৈতিকভাবে যারা নিচের দিকে আছে, তাদেরই আনাগোনা বেশি। কিন্তু, রোগী একা আসেন না বা একা অবস্থান করেন না। সাথে আসেন তাদের আত্মীয় স্বজন। একটি বেডে সর্বোচ্চ ২১ জন (সম্ভাবত) এটেনডেন্স ও লক্ষ্য করেছেন শাহাদুজ্জামান। প্রাথমিকভাবে এদের কে ঝঞ্ঝাট মনে হলেও, রোগীর এটেনডেন্স ছাড়া একটি ওয়ার্ড অচল। রোগিকে যে সেবা নার্সদের দেওয়ার কথা, তার প্রায় সবটাই দিয়ে থাকেন এই এটেনডেন্সরা। এর মূল কারণই ওয়ার্ডে লোকবলের অভাব।
ঘ. ওয়ার্ডবয়, ঝাড়ুদার, দারোয়ান : ক্ষুদ্র কিন্তু ক্ষমতাবান ওয়ার্ডবয়, ঝাড়ুদার, দারোয়ান। এরা একটি হাসপাতালের সবচে নিচের দিকের কর্মচারী হলেও, এদের ক্ষমতা সবচে বেশি। শুধু এরাই একটি হাসপাতালকে অকার্যকর করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এরা জড়িয়ে আছে সব'চে বেশি দুর্নিতি, দারিদ্রতার দুষ্টচক্র, কেন্দ্রীর রাজনীতির সাথে।
ঙ. নার্স : প্রদীপবিহীন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল নার্স। সাদা শাড়ির এই দলই সেবিকার কাজ করার কথা থাকলেও, মূলত সেই কাজে তাদের প্রায়শই অনুপস্থিত দেখা যায়। কিন্তু কেন? এই অধ্যায়ে এর উত্তরটিই পাওয়া গেছে। এছাড়া নার্সির পেশার সাথে ধর্মীয় বাঁধা, সামাজিক হেয়প্রতিপন্নতা সহ নানান দিক উঠে এসেছে।
চ. ��াক্তারঃ দম্ভ আর হতাশার যুগলবন্দী এই অধ্যায়টা সবচে আকর্ষনীয়। মূলত, আমাদের দেশে একজন রোগী আর ডাক্তারের মধ্যকার দূরত্ব অনেক বেশি। সেকারনেই এই অধ্যায়টা পড়ার অনুভূতি একটু অন্যরকম। ডাক্তারদের সীমাবদ্ধতা, হতাশা, অনিহা, অভিযোগ, দম্ভ, সেবা, মানবিকতা সকল কিছুর এক মেলবন্ধন ঘটেছে এ অধ্যায়ে। আর তার বহিঃপ্রকাশ সর্বশেষ পরে রোগীর উপরই। তবুও, হাসপাতালে তারাই ঈশ্বর।
ছ. হাসপাতাল : ক্ষুদ্র বাংলাদেশ এঅধ্যায়ে একটি হাসপাতালকে তুলনা করা হয়েছে একটি ক্ষুদ্র বাংলাদেশের সাথে। দরিদ্রতা, সামাজিক ভেদাভেদ, পরিবার, সহিংসতা, নারীর অদৃশ্যতা, নীতিহীনতা, সৃজনশীলতা সবটাই একটা ক্ষুদ্র বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে।
জ. শেষের কবিতা দেড় পেজের একটা অধ্যায়। চমৎকার ভাবে একটা ফ্ল্যাশবাক পেয়েছি।
পুরো বইটাতে একটি হাসাপাতালের প্রায় সব দিকই তুলে এনেছেন শাহাদুজ্জামান। তিনি একটি সরকারি হাসপাতালের ব্যাপারে দেখালেও, বেসরকারি হাসপাতালের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এখানের চিত্রটা খুব বেশি ভিন্ন না।
সর্বোপরি একটি হাসপাতালের দুর্নিতি, অব্যাবস্থাপনা, বাজেট সংকট, অবহেলা এসবের মূলে রয়েছে আমাদের কেন্দ্রীর রাজনীতির বেড়াজাল। যেমন:
হাসপাতালের একজন সেনাকর্মকর্তা-ডিরেক্টর আমাকে বলছিলেন,
"এ ধরনের একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আমি মিস ফিট। আই অ্যাম এ বার্ড অফ এ ডিফারেন্ট ফেদার। আর্মিতে আমরা একটা স্ট্রিক্ট চেইন অব কমান্ডের ভিতর কাজ করি। এখানে তো কোন কমান্ড-টমান্ড কাজ করে না। এখানে তো ফোর্থ-ক্লাস এমপ্লয়িরাই পাওয়ারফুল।
অনেক ডাক্তার, পুলিশ, পলিটিক্যাল লিডাররা এদের পেছনে আছে। আমি এখানে কী করতে পারি, আমি কোনো অ্যাকশন নিতে গেলেই ওরা স্ট্রাইক ডেকে বসে। আর হাসপাতালে ওয়ার্ড-বয়, আয়া, ক্লিনার-এরা কাজ না করলে হাসপাতাল তো কলাপ্স করবেই। ওদের ছাড়া তো আমরা হ্যান্ডিক্যাপ্ট। সুতরাং এদের অনেক কাজকর্মকে আমার ওভারলুক ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। "
পার্কভিউ হসপিটালে এসে বসে আছি। স্মৃতি থেকে দেখলে পারিবারিক অসুস্থতার কারণে গত তিনবছরের প্রায় অর্ধেকটাই হসপিটাল ক্লিনিকে কাটিয়ে দিলাম। হসপিটালের ডেটল মারা গন্ধ, হুশহাশ কোলাহল, এই হাসি এই চিৎকার সব যেনো সাধারণ। একঘেয়েমি পূর্ণ দীর্ঘশ্বাসটাও অভ্যেস হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে এটাকেই বেশ নরমাল মনে হয়। মানুষ কিছু একটা নিয়ে বাঁচতে ভালোবাসে। আল্লাহ ভগবান ঈশ্বরের মতো অসুখটাও যেনো বেঁচে থাকার আরেকটা রসদ। রসদ বলাটা বোধহয় ভুল হোলো। বলা দরকার অবলম্বন। পোড় খাওয়া মানুষ যেমন অলৌকিকতা আঁকড়ে ধরে তেমনি অধিক পাওয়া লওয়া মানুষও খুঁজে পেরে অলৌকিকতা। প্রথম দল ধরে থাকে, ধরার মতো কিছু নাই বলে। আর দ্বিতীয় দল, প্রাপ্ত জিনিসটা যাতে খোয়া না যায়! অসুখটা বড়োলোকের জন্য বিলাসিতা। আমার অবজারভেশন বলে, বড়লোকদের মধ্যে অন্যদের ঠকানোর জন্য একটা পাপবোধ কাজ করে (সবসময় যে এমন হয় তা না, সবাই ঠকায়ও না, তাও পাপবোধটা কাজ করে। মানুষ হয়ে পৃথিবীতে আসার খাতিরে সূক্ষ্ম কিছু অনুভূতি মাঝে মাঝে হানা দেয়, বড়লোকদের নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ওই অনূভুতি একান্ত প্রয়োজনীয়!) অসুখ বিসুখ সেই পাপবোধটাকে লঘু করে দেয়। গরীবের জন্য অসুখটা একটা স্বান্তনা। তারা স্বান্তনাটা পায় দুইভাবে। এক, ঈশ্বর আল্লাহ ভগবান তাদেরই বেশি রোগশোক দেয় যাদের বেশি ভালোবাসে। দুই, অসুস্থতার বৌদলতে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে দেখে যারা তাদেরই মতো ভুক্তভোগী। তা-ই দেখে তারা “কেউ সুখে নাই” বলে একটা শ্বাস ফেলে স্বান্তনা পায়। হাসপাতাল শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিষ্ঠানই নয়, হাসপাতাল কোন কোন ক্ষেত্রে ছোট সমাজ বড় সমাজের সাথে, ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে একাত্মবোধ হওয়ার একটা ক্ষেত্র। শাহাদুজ্জামান "একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়" বইয়ে এমন অসংলগ্ন অগভীর দুর্বল অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন অভিজ্ঞতার কথা শোনাননি অবশ্য। তিনি যা শুনিয়েছেন তা অত্যন্ত পীড়াদায়ক তবে একদম নিখুঁত পর্যায়ের সত্য। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় একটি হাসপাতালের একটিমাত্র ওয়ার্ডের গভীর নৃতাত্ত্বিক গবেষণা করে আমাদের দেখান কিভাবে হাসপাতালের একটি ওয়ার্ড সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র ধারণ করে। তিনি আমাদের দেখান, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদে চাচাতো ভাইদের কাছে হাত হারানো কবির নাম্নী ভদ্রলোক কিভাবে ভাঙ্গা হুইলচেয়ারে বসে রক্তাক্ত কাটা কব্জি উঁচিয়ে ধরে মঞ্চ অভিনেতার মতো বলছেন, "দেখেন, দেখেন কেমনে ওরা আমার হাত দুইটা কাইটা ফালাইছে।" প্রফেসরের রাউন্ডের শেষে খালেকের বিছানার নিচে এতক্ষণ লুকিয়ে থাকা তার স্ত্রী হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছেন বাইরে। ইটের টুকরায় টানা দিয়ে রাখা হয়েছে রমজান আলীর পা, তিনি তার পায়ের এক্স- রে প্লেটটি আলোর উল্টো দিকে ধরে বুঝতে চেষ্টা করছেন। পথ দিয়ে যাবার সময় এক ডাক্তার রমজান আলীকে বলছেন, 'আপনে এক্স-রে নিয়ে এত নাড়াচাড়া করেন কেন? ডাক্তার হইতে চান? অপারেশন থিয়েটারের জানালার কাঁচে সাটা একটি নোট : মনে রাখবেন আজকে ও'টিতে কটন, লাইসল এবং গজের সাপ্লাই নাই।' বাবার অপারেশনের জন্য কিনে আনা ওষুধগুলো ওয়ার্ড-বয় চুরি করেছে জানতে পেরে ও’টির সামনে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আলী আহমদ। নার্সদের সাদা ড্রেস দেখে নার্সিং পেশায় এসেছিলেন যে হাসিনা, সে এখন হতাশ হয়ে বলছেন, নার্সিং তার ভালো লাগে না, কারণ লোকে নার্সদের নিচু চোখে দেখে, মনে করে নার্সরা খারাপ মেয়ে। একজন ডাক্তার মাইক্রোফোনের সামনে চিৎকার করে বলছেন, 'আমরা স্ট্রাইক ডাকছি ডাক্তারি পেশার মর্যাদা রাখবার জন্য'।ডাক্তারদের স্ট্রাইকের কারণে ড্রেসিং হচ্ছে না বলে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে রোগীদের ব্যান্ডেজ থেকে। একজন রোগী সুগন্ধী আতর ঢেলে দিচ্ছেন, না বদলানো ব্যান্ডেজগুলোর উপর। এক ওয়ার্ডবয় জনৈক রোগীর মা'কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছেন ওয়ার্ডের বাইরে। হাসপাতালের চত্বর জুড়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ইউনিয়নের নির্বাচনের রঙ্গীন পোস্টার, ব্যানার। ট্রলীর একটি পায়া ধরে নিচুস্বরে কাঁদছেন একজন মহিলা, ট্রলিতে তার ছেলের শব। মহিলা বিলাপ করে সেই ইলিশ মাছের কথা বলছেন যা তিনি স্কুল থেকে ফেরার পর ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য রাঁধছিলেন। বইয়ের সব শেষ "শেষের কবিতা" অনুচ্ছেদে শাহাদুজ্জামান আমাদের বলছেন, " ডাক্তার হিসেবে মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে আমি কাটিয়েছি অনেকদিন কিন্তু এই গবেষণা করতে গিয়ে মনে হয়েছে এ হাসপাতালকে আমি যেন ঠিক চিনতাম না আগে, চিনলাম নতুন করে। মনে পড়েছে T.S Eliot এর কয়েকটি লাইন : shall not cease from exploration And the end of all our exploring Will be to arrive where we started And know the place from the first time (Little Giddings)
নিরপেক্ষ একটা গবেষণা। হাসপাতালের উপর এমন গবেষণা তাও নির্দিষ্ট একটা সেক্টরে সেটা খুবই কম আছে। আছে কিনা তাও জানি না। সব দিক থেকে লেখকের গবেষণা আর প্রকাশের ধরনটা ভিন্ন ধাঁচের। এজন্য পড়তেও আরাম। রোগীদের গল্প গুলোও বলা যেন আরো পড়তে উপভোগ্য করে তুলে। মনেই হয়নি গবেষণামূলক বই পড়ছি। কত সুখপাঠ্য। লেখক��র লেখার হাত আরো উপভোগ্য করে তুুলেছে।
তবে, হাসপাতালের এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করা চারটি খানি কথা নয়। লেখক নিজে যা দেখেছেন ফুটিয়ে তুলেছেন। সব কিছু সুন্দর করে বিশ্লেষণ করেছেন। যেটা খুব জরুরি ছিল বইটার জন্য। আমিও হাসপাতালে গিয়ে এসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি বেশ কয়েকবার। এজন্য, এটা খুবই কমন বিষয়। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালে। নৃতত্ত্ব বিষয়ে এমন গবেষণা পত্র অনেক মানুষকে হেল্প করবে যারা এই বিষয়ে তেমন কিছু জানে না বিশেষ করে তাদের জন্য সহজ। বুঝতে পারবে, হয়ত এমন পরিস্থিতিতে সামলে উঠতেও পারবে।
সে যাই হোক, একটা আফসোস থাকবে, বইটা এতদিন অন্য বইদের ভিড়ে ফেলে রেখেছিলাম। যেটা খুবই খারাপ লাগল এখন এসে। হয়ত আরো আগে পড়া উচিত ছিল!
আত্মজীবনী ব্যাতিত নন ফিকশন পড়ায় আমার ব্যপক আলস্য। এজন্য হার্ড কপি কিনে ফেলে রেখেছিলাম অনেক দিন হলো। গত দুইদিনে খানিকটা অবসর মেলায��� পড়ে ফেললাম বইটা। অতি চমৎকার একখানা পুস্তক!
লেখক অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের একটি অর্থোপেডিক হাসপাতালের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন যা আদতে রিপ্রেজেন্ট করছে সমগ্র দেশকে! সরকারী হাসপাতালের প্রতিটি স্তরের করাপশন, সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করেছেন রোগী, তাদের আত্মীয়, ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, ঝাড়ুদার, দারোয়ান এদের সবার প্রেক্ষাপট থেকে। পেশায় চিকিৎসক হবার সুবাদে হাসপ��তাল জীবনের কিছু নিবিড় ছবি পর্যবেক্ষণের সুযোগ হাতে কলমে ঘটেছে। কিন্তু এই গবেষণা গ্রন্থ পাঠ করে অন্য সকল শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের হাসপাতাল, চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুদাবনের সুযোগ পাচ্ছি৷
রোগীর আত্মীয়-স্বজনের ইতিবৃত্ত পড়তে গিয়ে ইন্টার্নশীপ পিরিয়ডের এক মজার অঘটনের কথা মনে পড়ে গেলো৷ তখন মেডিসিন ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট চলছিল। ধারণ ক্ষমতারও বেশী রোগী হাসপাতালে ভর্তি থাকার কারণে প্রফেসর রাউন্ড দেবার সময় রোগীর এটেন্ডেন্ট ওয়ার্ডে ভীড় করে থাকলে বেজায় চটে যেতাম৷ একবার হয়েছে কি রাউন্ড চলাকালীন সময়ে রোগীর সাথে একজনের অধিক এটেন্ডেন্ট থাকার কারণে এক লোককে আচ্ছামত বকে দিলাম। পরে রাউন্ড শেষে ডক্টরস রুমে আসার পর আমার এসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার জানালেন উনি আমাদের আরেক ডিপার্টমেন্টের নতুন এসোসিয়েট প্রফেসর! বোঝেন আমার অবস্থা!
সে যাকগে। শাহাদুজ্জামান স্যারের লেখা এর আগে পড়েছিলাম কেবল ক্রাচের কর্নেল। তেমন দাগ কাটেনি মনে। বরং কর্নেল তাহেরকে হিরো হিসেবে উপস্থানের চেষ্টা কিঞ্চিত বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছিল। এই বই পড়ে রীতিমতো মুগ্ধ!
এক অধ্যায়ে "দারিদ্র" আর "দারিদ্র্য" এই দুই শব্দের প্রয়োগ দেখে খানিকটা কনফিউজড হয়ে গেছি। বানান ভুল নাকি আসলেই এই দুই শব্দের অর্থের ভিন্নতা আছে ব্যাপারটা কেউ ব্যাখ্যা করলে কৃতার্থ হবো!
শাহাদুজ্জামানের লেখা বরাবরই একটু অন্যরকমের। কিন্তু পিএইচডি থিসিসের ভাবানুবাদ যে সাহিত্য হতে পারে, এটা কল্পনাও করি নাই! বেশ সুলিখিত বই। লেখক দীর্ঘদিন একটি সরকারি হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে কাটিয়েছেন গবেষণার জন্য- পর্যবেক্ষণ করেছেন হাসপাতালের অবস্থা। কথা বলেছেন ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে চিকিৎসক পর্যন্ত, সবার সাথেই। জেনেছেন তাদের সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ-হতাশার কথা।
রোগী, তার আত্মীয়স্বজন, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, নার্স, ডাক্তার- প্রত্যেকের অবস্থান বর্ণনা করেছেন আলাদা আলাদা অধ্যায়ে। সরকারি হাসপাতাল কীভাবে চলে, সেটার ধারণা পেতে সহায়ক। বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না আগে। এই বই পড়ে জানলাম। সরকারি হাসপাতালের একটি ওয়ার্ড যে বাংলাদেশেরই একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ, এটা দেখানোই ছিল গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। একেবারে শেষে ঐ ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে।
সুখপাঠ্য বই। একটু ধীরগতির, তবে গবেষণার কচকচানি নেই।
বাংলাদেশের হাসপাতাল নিয়ে এদেশের অধিকাংশ মানুষই হতাশ। সেটা যদি সরকারি হাসপাতাল হয় তা হলে তো আর কথাই নেই। আমাদের রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনার একটা নগ্ন চিত্র ফুটে উঠে এদেশের যেকোন সরকারি হাসপাতালের দিকে তাকালে। তবে এই পরিস্থিতি কেন কীভাবে হল আর মূল সমস্যাটা কোথায় তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামায় না। খালি ব্লেম গেইম খেলেই আমরা সন্তুষ্ট।
শাহাদুজ্জামান এই বইতে চেষ্টা করেছেন হাসপাতালের জগতটাকে বুঝতে এবং হাসপাতালের ক্ষুদ্র একটি ওয়ার্ডকে আয়না হিসেবে ধরে পুরো বাংলাদেশকে তাতে প্রতিফলিত করতে। সন্দেহ নেই এতে তিনি পুরোপুরিই সফল।
বইটিতে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা হয়নি৷ রোগী, রোগীর আত্মীয়, নার্স, ওয়ার্ডবয়, ডাক্তার - এ সবাইকে নিয়ে একটি হাসপাতাল। এখানে সবার ক্ষোভ আর হতাশা আছে। লেখক তার গবেষণাকালীন সবার সাথেই কথা বলেছেন। এরপর নিরেপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটা গ্রুপকে বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পায় সিস্টেম কিভাবে একটা কর্মট, উদ্যোগী আর সেবার মনোবৃত্তিওয়ালা মানুষকে উগ্র আর বদমেজাজি করে তুলছে। ডাক্তার-নার্সরা চাইলেও এদেশে ভাল সেবা দিতে পারে না। এমনকি কাজের মানসিক চাপ তাদেরকে এতই যান্ত্রিক করে তোলে যে বেশিরভাগ সময় তারা ভাল ব্যবহারটুকুও রোগীকে দিতে পারেন না। তবে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও তারা রোগীদের সেবা দিয়ে যান। বইটিতে লেখক ডাক্তারদের নানা সৃজনশীল পদ্ধতিতে চিকিৎসার উল্লেখ করেছেন যা দিয়ে তারা ওষুধ পথ্যের চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবকে কাটিয়ে দেবা দিয়ে যান।
প্রায় ২ যুগ আগে লেখা বই। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল আজও বইটি প্রাসংগিক৷ হাসপাতালে কিছুদিন কাটিয়েছে এমন দুর্ভাগামাত্রই বইটিকে relate করতে পারবে। আমি এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে একজন তরুণ বইটি পড়বে আর অবাক হয়ে ভাববে - "এভাবেও চিকিৎসা হত তখনকার বাংলাদেশে! ভাগ্যিস ওই সময়ে জন্মিনি"
শাহাদুজ্জামানের গবেষণার বিষয়-নির্বাচনের ব্যাপারটি আমার ভালো লেগেছে। ইন্সট্যান্ট নুড্লসের এই যুগে অনেকেরই একটা ঝোঁক থাকে সবচেয়ে কম পরিশ্রমে সর্বাধিক সাফল্য পাবার। কেবল পিএইচডি গবেষণাই না, আমাদের ভার্সিটির সাধারণ টার্ম প্রজেক্টের সময়েও দেখি ছেলেমেয়েরা সহজতম বিষয় নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করে— অতীতে হুবহু যে কাজগুলো অসংখ্যবার করে বড় ভাইয়াপুরা করে গেছে, এবং যে কাজগুলো আদৌ পরীক্ষায় একটা স্কোর পাওয়া ছাড়া অন্য কোথাও ভূমিকা রাখছে না। অর্থাৎ কাজের ক্ষেত্রে স্বীকৃতিটাই (certificate) মুখ্য, সমাজে প্রভাব (impact) রাখাটা গৌণ।
শাহাদুজ্জামানের কৃতিত্বটা প্রথমত এখানে যে, তিনি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নতুন এক ধরনের গবেষণা করে হাসপাতালগুলোর অবস্থা তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয়ত, গবেষণাপত্রের দেবভাষার মর্মোদ্ধার যেহেতু সাধারণ মানুষের কম্মো না—তিনি পুরো গবেষণাটাকে মনুষ্যভাষায় লিখে রেখেছেন। আমি মনে করি এটা একবিংশ শতাব্দী শুরুর প্রাকমুহূর্তে বাংলাদেশের হাসপাতালব্যবস্থার একটা গ্রহণযোগ্য রেফারেন্স হতে পারে। এবং এই রেফারেন্স পাঠের ফলে আমাদের মধ্যে কিছু বোধ জাগ্রত হবে—যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, হাসপাতালের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুব বেশি ঘনিষ্ঠ—আমরা কেউই জানি না আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোনো হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের টিমটিমে বাতির নিচে আমাদের টিকেটের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কিনা।
কিন্তু তবু, যে বোধ জাগ্রত হয়েছে তা কি বায়াজ্ড? যদিও সকল পর্যবেক্ষণই আপেক্ষিক, কিন্তু এ বইতে রোগীর প্রতি শাহাদুজ্জামানের যতখানি সহমর্মিতা দেখা গেছে—হাসপাতালের বাকি সকল চরিত্রের (ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, অন্যান্য চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) ক্ষেত্রে অতটা দেখা যায়নি। যদিও তিনি বলেছেন বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ক্ষোভের কথা, বলেছেন নার্সদের জীবনের হতাশার কথা, ওয়ার্ডবয়দের চরম দারিদ্রের কথা—কিন্তু এরপরেও এ চরিত্রগুলো এ বইয়ের খলনায়ক হিসেবেই এসেছে।
এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা এমন হতে পারে যে, দু হাত কাটা পড়ে যে ব্যক্তিটি হাসপাতালের ওয়ার্ডে শুয়ে আছে—তার আসলে খলনায়ক হবার তেমন কোনো সুযোগ নেই। এবং শাহাদুজ্জামান চাঁদের উল্টো পিঠেই (dark side of the moon) হয়তো বেশি আলোকপাত করতে চেয়েছেন। সমস্যাগুলো দূর করার জন্য প্রথমে চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকানোটা জরুরি।
শাহাদুজ্জামান যখন এই ‘খলনায়ক’-দের সাথে তাদের খলনায়কত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গেছেন—তখন সকলেই দায়টা উর্ধ্বতর পর্যায��ে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। কিন্তু আমি বেশ কৌতূহলের সাথে লক্ষ্য করি, ওয়ার্ডবয় যেমন মনে করে তার বেতন যথেষ্ট নয়, সুতরাং রোগীদেরকে বখশিস দিতে বাধ্য করা তার নৈতিক অধিকার—তেমনই ডাক্তারও মনে করে তার বেতনটা বড্ড কম, কাজেই অফিস শেষ হবার আগেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে যাবার অধিকার তার আছে।
পুরো ব্যাপারটাকে আমি ‘খাই খাই’ মনোভাবের একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছি।
খলনায়কত্বের আরেকটা বড় রূপ হল রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা। বইয়ে উল্লেখিত প্রফেসর ডাক্তারদের এর পরিপ্রেক্ষিতে খুব চমৎকার একটা মন্তব্য করেছেন। তিনি নিজেই দুর্ব্যবহারের কথা স্বীকার করে বলেছেন, আমাদের মেডিকেল কারিকুলামে উচিত একটা বিহেভিয়েরাল ট্রেইনিং থাকা।
এ ব্যাপারটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ রোগীদের সাথে বাজে ব্যবহারের কারণ হিসেবে অধিকাংশ ডাক্তারই বলে থাকেন রোগীর অশিক্ষিত-মনোভাবের কথা। কিন্তু সত্যি কথা হল এই যে, “আমার পাশের বেডের লোকটাকে বড় ক্যাপসুল দিলেন আমারটা ছোট কেন”— এমন কথা শুনেই আসলে ডাক্তারের মাথা গরম করলে চলে না। নাইটিঙ্গেলকেও নিশ্চয়ই দিনের পর দিন এমন হাস্যকর বক্তব্য শুনতে হত, এবং তিনি খেপে গিয়ে চিৎকার করেছেন—এমন কোনো নিদর্শন আছে বলে জানি না।
তবে এর বিপরীতে আমাদের স্বল্প-সাধ্যের-হাসপাতালে ডাক্তারদের উদ্ভাবনী কাজকর্মের একটা ছোট চিত্রও দেখা গেছে। এটাও আমাদের স্বল্প-সাধ্যের-দেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরই উদাহরণ।
শাহাদুজ্জামান এ বইতে কোনো সমাধান উল্লেখ করেননি। তিনি কেবল হাসপাতালকে পুরো দেশের একটা ক্ষুদ্র চিত্র হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। ঐতিহাসিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে সেটা চমৎকারভাবে দেখাতেও পেরেছেন।
আমি মনে করি হাসপাতালের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি মানুষের ঘাড় (কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাত-পা) ধরে এ বইটা পড়ানো উচিত। নিজের কর্মক্ষেত্র সম্পর্���ে বোধ জাগ্রত হওয়া যেকোন মানুষের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণার পেপার পড়াটা চিরকালই যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু রস-কসহীন বিষয়কে এতো সুন্দর, প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করতে পারাটা আসলেই বিশাল ব্যাপার। এটা হয়তো শাহাদুজ্জামান বলেই সম্ভব হয়েছে। এই বইটার কন্টেন্ট আর ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা মিলিয়ে আরও বিশদভাবে কিছু লেখার আছে... লিখব অবশ্যই কোন এক সময়।
বাংলাদেশের একটি টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে শাহাদুজ্জামানের অসাধারণ গবেষণার ফসল বইটি। একমাত্র শাহাদুজ্জামানই পারেন নিজের ডাক্তার পরিচয়টা সামলেও এমন একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করার। বইটিতে বাংলাদেশের দরিদ্র ও সমস্যাসংকুল পরিবেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার নৃতাত্ত্বিক ও আর্থ-সামাজিক সামগ্রিক ছবি ফুটে উঠেছে। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের চুরি-দুর্নীতি, নার্সদের হতাশাসঞ্জাত অবহেলা, ডাক্তারদের উদ্ভাবনা ও হতাশা- সবই উঠে এসেছে অনুপুঙ্খ বাস্তবতায়। বইটির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শিরোনাম এমনঃ
-ওয়ার্ডবয়, ঝাড়ুদার, দারোয়ানঃ ক্ষুদ্র কিন্তু ক্ষমতাবান -নার্সঃ প্রদীপবিহীন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল -ডাক্তারঃ দম্ভ আর হতাশার যুগলবন্দী।
এমন যথার্থ বর্ণনা আর কেউ করতে পারেন নি। তবে এ বিষয়ে আরো কাজ করবার সুযোগ রয়েছে।
My husband recommended this book to me saying "look here's a book that you're surely going to enjoy!" and he was absolutely correct about his notion. I have just finished reading a hard-bound version of the book only to find myself going online to review it. I loved the author's honest and competent way that describes a much untold, unseen, unfelt, and surely a very unpleasant yet hopeful situation of our hospitals and the system in an easy and flawless language and arrangements. Being a doctor myself and a public health practitioner living in Bangladesh working with the doctors and nurses and FWVs to help them in acquiring a state of the art skill of abortion care in place of an old rusty method-D&C, I have felt that we needed such books for a long time but this is the only one I know about. I would recommend this book to my colleagues and friends to explore another aspect & vision that they often fail to see that how they sound when they behave, how Nurses & other aides feel working with them; most importantly how the patients, their beneficiaries are seeing them. This book is inspiring, thought provoking and a very valuable document for Bangladeshi public health professionals working as "change agents" in this sector. Thank you so much Shahaduzzaman vai!
বইটি বাংলাদেশের একটি হাসপাতালের উপর লিখা। চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী শাহাদুজ্জামান একটি হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের উপর গবেষণা করে এটি লিখেছেন। এখানে তিনি একটি হাসপাতালের নানা দৃশ্য ও চরিত্রগুলো তুলে ধরেছেন। হাসপাতালের রোগী, রোগীর অাত্নীয়-পরিজন, ওয়ার্ড বয়, অায়া, দারোয়ান, নার্স, ডাক্তার, অপারেশন রুম, ওয়ার্ড, মেডিকেল রাজনীতি সহ নানাবিধ জিনিসের বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। উঠে এসেছে নানা রকম অাশা, নিরাশা, জীবন-মৃত্যু ও বাস্তবতার কাহিনী। প্রায় ৫ মাস সশরীরে এ হাসপাতালটি পর্যবেক্ষণ করে যা দেখেছেন, তাই উঠে এসেছে এখানে।
অনেক চমৎকার একটা বই। মেডিকেল লাইনের সাথে জড়িত সকলের এটা একবার পড়া দরকার। হাসপাতাল জীবন ও কর্মকান্ড নিয়ে যাদের অনেক অাগ্রহ অাছে, তাঁরাও পড়ে দেখতে পারেন।
একটি নন ফিকশন যে একটানে পড়ে ফেলা যায়, তা সম্ভবত শাহাদুজ্জামানের বই না পড়লে বোঝা যেত না। নন-ফিকশন বলতে আমরা বুঝি খটোমটো বই, যাতে কঠিন কঠিন শব্দ, জটিল বাক্যগঠন এবং ততোধিক প্যাঁচালো যুক্তির ছড়াছড়ি থাকবে। এই দিক থেকে শাহাদুজ্জামান এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। পিএইচডির থিসিস! ভাবা যায়, একটি থিসিসের ভাবানুবাদ এত সহজ, বোধগম্য এবং সুপাঠ্য হতে পারে?
খুব সাবলীলভাবে বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশের একটি হাসপাতালের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই বইটিতে। লেখক নিজের উচ্চতর পড়াশোনার কাজেই খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন বাংলাদেশের একটি সরকারি হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের ডাক্তার, রোগী, রোগীর আত্মীয়-স্বজন, অন্যান্য কর্মচারী বা নার্সদের। ডাক্তারি যে স্রেফ একটি বৈজ্ঞানিক পেশা, এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে এই বই। বিশেষত লেখক নিজে মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা একজন ডাক্তার হয়েও হাসপাতালকে যে কেবল চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্র হিসেবে না দেখে একটুকরো সমাজ হিসেবে একজন নৃতাত্ত্বিকের চোখে দেখেছেন তাতে তিনি প্রশংসা পেতেই পারেন। বিশেষত যখন আমরা একজন ডাক্তারকে স্টেথো গলায় ঝুলিয়ে রোগীর নাড়ি টেপাটেপি ব্যতিত অন্য পেশায় কল্পনা করতে পারিনা বললেই চলে।
অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের বর্ণনায় চলে এসেছে বাংলাদেশের একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি সাধারণ ওয়ার্ডের চিত্র। লোকবল, অর্থবলের অভাব ও ঘুণেধরা সিস্টেমের যাঁতাকলে করুণ দশা থাকে হাসপাতালগুলোর। লেখক পর্যালোচনা করেছেন রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে, তাদের হিস্ট্রি সম্পর্কে, কিভাবে তারা আহত বা অসুস্থ হলেন, রোগীদের আর্থসামাজিক অবস্থা, নিজের রোগ সম্পর্কে নলেজের অভাব এবং তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে। একই ভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন হাসপাতালে রোগীর সেবা শুশ্রুষার দায়িত্বে থাকা আত্মীয়স্বজন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি, নার্স এবং ডাক্তারদের পার্সপেক্টিভ থেকে।
এ ধরনের পার্সপেক্টিভ থেকে লেখা প্রায় সব বইয়েই যে কথাটা বারবার প্রতিধ্বনির মত ফিরে ফিরে আসে তা হল, "সম্পদের অভাব এবং সিস্টেমগত অপ্রতুলতা"। এই বইটিও তার বাইরে নয়। তবে, সাধারণের বাইরে গিয়ে শাহাদুজ্জামান উদ্ভুত পরিস্থিতির পেছনে নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেও তুলনামূলক অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। পেশাগত হায়ারার্কি, সামাজিক অবস্থান এবং দরিদ্র দেশে চিকিৎসা পেশার যে রূপান্তরিত রূপ বিদ্যমান, সে বিষয় বেশ শক্তভাবে উঠে এসেছে এই বইয়ে।
ডাক্তারি পেশা সম্পর্কে অনেক কম জ্ঞান রেখেও আমি যে বইটি বুঝতে পেরেছি তার কৃতিত্ব লেখকের। উন্নত বাইণ্ডিং, ছাপা এবং বিশেষ করে শুদ্ধ বানানসমৃদ্ধ বাংলাদেশি প্রকাশনীর বইও অনেকদিন পরেই পড��তে পেলাম।
বইটি যেকোন মানুষের জন্য সুপাঠ্য হতে পারে। ডাক্তারদের পড়া উচিত কারণ এতে তারা মিছিলের বাইরে এসে মিছিলের অবস্থাটি দেখতে পাবেন। আর আমরা বাকিরা? আমরা সবাইই তো একদিন না একদিন রোগী হই... নাকি?
শাহাদুজ্জামানের পেশাগত জীবন নিয়ে আমার একধরণের মুগ্ধতা রয়েছে এই অর্থে যে, ডাক্তার হিসাবে একাডেমিক্যালি ট্রেইনিং প্রাপ্ত একজন লোক কাজ করলেন জনস্বাস্থ্য নিয়ে(তা-ও এমন এক সময়ে যখন "জনস্বাস্থ্য" buzzword ছিলো না), এরপর শেষে থিতু হলেন নৃবিজ্ঞানে- আরো নির্দিষ্ট করে বললে চিকিৎসা-নৃবিজ্ঞানে। একজন সত্যিকা��ের "ইন্টারডিসিপ্লিনারি" মানুষ! আর এটা একদম ঠিক ঠিক "চিকিৎসা-নৃবিজ্ঞান"র-ই বই!
বইটা পড়ে একদম "comprehensive" একটা ধারণা পেলাম "হাসপাতাল" নিয়ে। একটা দেশের হাসপাতালের মাধ্যমে সে দেশের পুরো "স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে"ই পড়তে পারা উচিত। তবে লেখক এই হাসপাতালকে দিয়ে " বাংলাদেশ"কেই পড়াতে চেয়েছেন এবং তার এই চাওয়াকে বারবার linkage দিয়ে প্রমাণ করতে সচেষ্ট থেকেছেন। যেটা পাঠককে একটা "greater perspective" দিবে!
বইটি লেখা হয়েছে হাসপাতালের "constituent মানুষ"গুলো নিয়ে- রোগী, রোগীর আত্মীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী(ওয়ার্ডবয়, দারোয়ান), নার্স, ডাক্তারদের নিয়ে। হাসপাতালে তাদের প্রতিদিনকার জীবন আলাদা আলাদা অধ্যায়ে বিস্তৃত পরিসরে লেখা আছে। আর সবশেষ অধ্যায় "বাংলাদেশ" নিয়ে; ঠিক যেমনটা লেখক চেয়েছেন- এদের সবার কাজের মাধ্যমে একটা "বাংলাদেশ"কে দেখা, এ দেশের সমাজকে দেখা। নৃবিজ্ঞানী বলে কথা!
আর ফাঁকে ফাঁকে লেখক যেসব নৃতাত্ত্বিক গবেষণাপত্রের রেফারেন্স দিয়েছেন তার মধ্যে কয়েকটি মনে ধরেছে- নিতান্ত এবং একান্ত অবসরে সেসব গবেষণাপত্র নেড়েচেড়ে দেখার আশা রাখি।
এই বইটা নিয়ে আমার মাত্রাছাড়া আগ্রহ ছিলো। অনেকটা মিটেছে তো বটেই! শাহাদুজ্জামানের সাহিত্য নিয়ে ফেসবুকে "fanboying" করার ফাঁকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অগ্রজ আমাকে এই বইয়ের খোঁজ দেন- তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
একটি হাসপাতালে অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের উপর গবেষনামূলক বইটি।হাসপাতালে জীবনের যে বিচিত্র রূপ দেখা যায় তা বোধকরি আর কোথাও দেখা যায় না।একই ওয়ার্ড থেকে কেউ জীবন নিয়ে ফেরে আবার কেউ ফেরে লাশ হয়ে।রোগী,রোগীর আত্মীয়,চিকিতসক,নার্স,ওয়ার্ডবয়,আয়া,ঝাড়ুদার সকলের মুখ থেকে নেওয়া নানারকম অভিজ্ঞতা।ক্রমাগত জীবন,মৃত্যু,রক্ত,দুর্ঘটনা শুধু নয় একটি ওয়ার্ডের চারদেয়ালের মাঝে যেন কখনো একটি সমাজ,একটি দেশের অবয়বও বোঝা যায় বৈ কি ।কত সৌভাগ্য আর কত দুর্ভাগ্যের কাহিনী,কত হাসি কত দীর্ঘশ্বাস।এরই প্রেক্ষিতে রচিত একটি নিরীক্ষাধর্মী বই। জীবনের অত্যন্ত বাস্তব নিরীক্ষা।লেখক নিজে একজন চিকিৎসক সে কারনেই হয়তো আরো জীবন্তভাবে তিনি প্রকাশ করতে পেরেছেন এই বিচিত্র বাস্তব চিত্র।
ইসলাম সম্পর্কে লেখকের ধারণার অভাব রয়েছে। নারীদেরকে যথোপযুক্ত পর্দার সহিত কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দেওয়া হয় না ইসলামি সমাজে। তাছাড়া লেখক (বা গবেষক) হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথার সাথে ইসলাম ধর্মের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে কীভাবে মেলালেন, তা বোধগম্য না। ইসলামে শ্রমের মর্যাদাকে কীভাবে দেখা হয়, সেটা তিনি পড়ে দেখবেন আশা করি। তাছাড়া বলতে পারি, এমন গবেষণামূলক বই রেলস্টেশনের বুক স্টলে লভ্য হওয়াটাই লেখকের সার্থকতাকে অনেকখানি প্রমাণ করে। নৃবিজ্ঞান নিয়ে যাদের ন্যূনতম আগ্রহ আছে, তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য এক ননফিকশন। তবে বইয়ে যথেষ্ট পরিমাণ অলঙ্করণ, লেখচিত্র, ছবি প্রভৃতি সংযুক্ত করলে আরো সুখপাঠ্য হতো।
হাসপাতাল কখনো কারো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য না। চরম বিপদের মুহুর্তেই কেবল সেখানে শরণাপন্ন হয় সবাই। লেখক এমন এক জায়গার সামগ্রিক চরিত্রে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন দারুণভাবে।
অসাধারণ কাজ। পুরো হাসপাতালে এদিক-ওদিকের গল্প, অনুশোচনা, অভাব, হতাশা ২০০ পৃষ্ঠায় তুলে ধরা চাট্টিখানি কাজ নয়। এই কাজটি গবেষক সুনিপুণ কায়দায় করতে পারায় তাকে বাহবা দিতে হয়।
অতীতের অতিথিশালা থেকে বিবর্তিত হয়ে এখনকার আধুনিক হাসপাতালের সরাসরি এবং বাস্তবিক শারিরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি রোগ-রোগী-চিকিৎসা সেবকের যে দার্শনিক বলয় রয়েছে সেটা অনেকটা-ই নিচে পড়ে যায়, পক্ষান্তরে এই নৃতাত্ত্বিক চিন্তাকে মানুষ ভুলেও যায়। আমরা সেগুলোকে সহজ দৃষ্টিকোণ থেকে খুঁজে না পেলেও লেখক তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এজন্য তিনি এদেশের চিরায়ত সরকারি হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডকে বেছে নিয়েছেন। সেখানকার দুঃখ, দূর্দশার পাশাপাশি সৃজনশীলতাকেও গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
নৃবিজ্ঞানী হিসেবে লেখক নিরপেক্ষ থেকে তাঁর গবেষণার পর্যবেক্ষণগুলোকে নানাভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। কোনোরূপ উপসংহারে না গিয়ে লেখক দেখিয়েছেন কিভাবে রোগ ও রোগীর পাশাপাশি সমস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে এখনও স্বাস্থ্য খাতের তুলনায় সামরিক খাতের বাৎসরিক বাজেট বহুলাংশে বেশি। এমন নানা অসঙ্গতির দরুণ চিকিৎসা সে���া নিতে আসা জনগণ তার প্রাপ্য চিকিৎসা পায় না বা পেতে নানা কাঠখড় পোড়াতে হয়। এদেশের ধনাঢ্যরা আধুনিকায়নের সকল সুযোগ পেলেও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নিতান্ত গরীব মানুষগুলো অবহেলিত থেকে যাচ্ছে।
হাসপাতালের একজন বড়লোক ডাক্তার ছোটলোক গরীব রোগীদের ওপর কর্তৃত্ব করেন। ডাক্তাররা ভাবেন- রোগের কারণ, নাম বা রোগমুক্তির উপায় এসব গরীব-অশিক্ষিত রোগীরা বুঝবে না এবং বোঝানোর প্রয়োজনও তাঁরা অনুভব করেন না। একটু সদ্ব্যবহার একজন রোগীকে কতটা সারিয়ে তুলতে পারে সেই মনস্তাত্ত্বিক বোধটুকু এদেশের শিক্ষিত চিকিৎসক সম��জে এখনও তৈরি হয়নি। এই অশিক্ষা দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে তৈরি হওয়া; যার সাথে যোগ হয়েছে রাষ্ট্রের সব অনিয়ম। এই দুইয়ে মিলে হাসপাতাল নামের প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে জনগনকে ঠকানোর ভিন্ন কোনো উপায় হিসেবে।
অপরদিকে, দেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত হওয়ার ফলে চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতার বদলে নানা কুসংস্কারে ডুবে থাকে। অশিক্ষা, অসচেতনতা ও কুসংস্কার মিলে তাঁদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে ভয়ের সংস্কৃতি। চিকিৎসা নিতে গিয়ে হাসপাতালের ব্যবস্থাকে সহজ করার বদলে আরো জটিল করে ফেলে। যার ফলে- সেবা দাতারাও তাঁদের সেবা প্রদানে ক্রমশ আগ্রহ হারায়। অনেকটা নিজেদের দোষেও তাঁদেরকে বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়।
একটি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবাকে কেন্দ্র করে রোগী, ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, রোগীর আত্মীয় স্বজন সহ চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত সবার সাথে একটি খণ্ডকালীন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লেখক শাহাদুজ্জামান তাঁর লেখা একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙা হাড় বইয়ে সেই সম্পর্ককেই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। হাসপাতাল জীবনকে তিনি ক্ষুদ্র বাংলাদেশ হিসেবে মঞ্চায়িত করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন।
প্রয়োজনের তুলনায় কম লোকবল, দায়িত্বের অসম বণ্টণ, অর্থিক অসচ্ছলতা সহ নানা অসঙ্গতি নিয়ে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। উন্নত বিশ্বের সাথে রয়েছে যার বিস্তর পার্থক্য। সেটা যে কেবল প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তা নয় বরং রোগী-ডাক্তার ও অন্যান্য স্টাফদের আচরণ গত দিক দিয়েও।
মানুষের এই ভেতরকার বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পূর্ণ-ই মনস্তাত্ত্বিক। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেকটা অগ্রসর হলেও এই আচরণগত দিকের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বছরের পর বছর ধরে যা একটু একটু করে মস্তিষ্কে প্রোথিত হয়েছে এবং সমস্যার পাশাপাশি বৃহদাকার সংকট তৈরি করেছে। এই বইয়ে সেই সংকট গুলোকেই বাস্তব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উত্থাপন করা হয়েছে।
বই পর্যালোচনা- বইয়ের নাম: একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙা হাড় লেখক: শাহাদুজ্জামান প্রকাশনী: মাওলা ব্রাদার্স পৃষ্টা সংখ্যা: বইয়ের দাম: ৩০০ টাকা (রকমারি মূল্য)
একটি সরকারি কলেজ হাসপাতালের বাস্তব প্রতিচ্ছবিঃ- একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়।
একটি সরকারি হাসপাতালের বাস্তব চিত্র কেমন হতে পারে তা জানতে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। অামাদের মতো নিম্নবিত্তের সে ধারণা কম বেশি অাছে বৈ কি! কিছু হলে ছুটে চলে যাওয়া হয় সরকারি হাসপাতালের করিডোরে। কিন্তু অামাদের ভাগ্যে চিকিৎসার নামে কি জোটে তা হয়তো অনেকে জেনেও না জানার ভান করে থাকেন। যারা সচক্ষে জানের তারা ঐ চোখের সামনের ঘটনাটুকু। কিন্তু মোদ্দা ব্যাপার তো রয়ে যায় লোক চক্ষুর অাড়ালে। হাসপাতালে আছে জীবন-মৃত্যুর লড়াই, আছে আশা-নিরাশার নাগরদোলা। হাসপাতাল কারো জন্য রোগ নিরাময়ের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র, অাবার কারো জন্য বিভীষিকার অন্ধকূপ।
বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপর একটি নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা ভিত্তিতে লেখা এই বইতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের একটি হাসপাতালের ভেতরকার বিচিত্র বাস্তব চিত্র!
শাহাদুজ্জামানের গবেষণাধর্মী লেখার জুড়ি মেলা ভার। একজন কমলালেবু, ক্রাচের কর্নেল এর মতে অসাধারণ লেখা যার থলেতে অাছে তার অসাধারণ লেখনীতে নির্মিত এই গবেষনাধর্মী লেখা। একটা থিসিস পেপার থেকে যে এত উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্য হতে পারে তা অামার জানা ছিলো না। লেখক বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওপর একটি নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছেন। নিজের উচ্চতর ডিগ্রির জন্য তিনি একটি হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের ডাক্তার, নার্স, রোগী, রোগীর অাত্মীয়, অায়া, ঝাড়ুদার সহ সকল প্রকার মানুষদের দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই গবেষণার ভিত্তিতে লেখা এই বইতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের একটি হাসপাতালের ভেতরকার বাস্তব সব চিত্র। বইয়ের ভেতর যে সমস্ত বিষয়ের বর্ণনা করা হয়েছে তা লিখতে খুব একটা কেও সাহস করে না। লেখাটি স্রেফ একটি বই নয়, গল্পটি একটি গবেষণা ধর্মী লেখা সুতরাং লেখায় সত্যিকার চিত্র চিত্রিত হয়েছে।
আধুনিক সমাজের অন্যতম জটিল একটি প্রতিষ্ঠান হল হাসপাতাল। যেখানে সেবার সাথে অায়-উপার্জনও সম্ভব। কিন্তু সেখানে ভোগান্তিও খুব বেশি। যেখানে ডাক্তারের থেকে অায়া বুয়াদের খবরদারী চলে বেশি চলে। হাসপাতালে থেকে চেম্বারে বেশি সময় যায় ডাক্তার বাবুদের। হাসপাতালের ঔষধ যায় ফার্মেসীর দোকানে। সব মিলে একটি ঘুনেধরা সিষ্টেম অার অর্থ-লোক বলের অভাবে ভেঙে পড়া মেরুদণ্ড দিয়ে অর্ধ শোয়া সমাজ। কিভাবে ঘটে এইসব? সব কিছু কি হত্যাকর্তাদের অগোচরে? সকল ক্ষমতার উৎস কোথায়? অার কেনই বা ঘটে এই সব। যেখানে সেবার থেকে টাকার খেলা সেখানে এমন চিত্র কি স্বাভাবিক ঘটনা?
মোদ্দা কথা একটি হাসপাতালের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে যদি অাপনার অাগ্রহ থাকে তবে এই বই অাপনার জন্য। হাসপাতালে একজন রোগীর ভাগ্যে কি ঘটে, একজন নার্সের খিটমিট স্বভাব অার ডাক্তারের গতিবিধি সম্পর্কে জানতে চাইলে এই বই অাপনার জন্য। সুখপাঠ্য লেখা পড়তে অাগ্রহী হলেও এই বই অাপনার জন্য।
নন ফিকশন মানে খটমট শব্দে দাঁতভাঙা উচ্চারণের উচ্চ মার্গীয় অালোচনা। কিন্তু লেখক এই ধারাকে ভেঙেছেন। খুব সহজ সরল সাবলীল শব্দের নন ফিকশন খুবই কম পড়েছে। বিশেষ করে হাসপাতালে উপর গবেষণা নিয়ে এমন অসাধারণ বর্ণনা বাংলায় অামার চোখে পড়েনি। তবে লেখক হিসাবে একটা জিনিস করেছেন তা হল গল্পের শেষে মাঝে কোথাও সমস্যার সমাধান টানেননি। এত এত সমস্যা, ঘটনার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বর্ণনা করে গেছেন কিন্তু সমাধান রেখে গেছেন সাধারণ মানুষের উপর। তবে পরিশেষে বলতে হয়, অাদ্যোপন্ত চিন্তা ভাবনা বদলে দেওয়ার জন্য এই বই অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
বইঃ একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়। লেখকঃ শাহাদুজ্জামান প্রকাশনীঃ মাওলা ব্রাদার্স মূল্যঃ দুইশত পঞ্চাশ টাকা।
“রোগ মানুষেরই বয়সী”, কিন্তু হাসপাতালের বয়স খুব বেশি নয়। ইউরোপীয় রেঁনেসার পর ষোল-সতের শতকে বর্তমান হাসপাতালের সূচনা হয়। রোগ নিরাময় কেন্দ্র হতে পুঁজিবাদের ছোঁয়ায় নিখাদ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত হয় পশ্চিমা বিশ্বের হাসপাতাল সমূহ। ভারতীয় উপমহাদেশে এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা এসেছে খ্রিষ্টান মিশনারী এবং উপনিবেশ স্থাপকারীদের হাত ধরে। কালের বিবর্তনে পুঁজিবাদের স্পর্শ লেগেছে এদেশের হাসপাতাল সেক্টরেও তারই বদৌলতে প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়গনষ্টিক সেন্টার, বেসকারি হাসপাতাল ইত্যাদি সেবা প্রদানকারী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসা এবং পর্যাপ্ত সেবা প্রদান করতেও তারা সক্ষম। কিন্তু, প্রেক্ষাপটটি যেহেতু বাংলাদেশ সেহেতু মাথায় রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাটিকে। দারিদ্রতাঃ বাংলাদেশের দারিদ্র্যতার হার ২০১৯ : দারিদ্র্য হার ২০.৫ এবং হত দারিদ্র্য হার ১০.৫। তারমানে এখনও ১০.৫ ���তাংশ মানুষ বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরনেও ব্যর্থ। দরিদ্র এবং নিন্মবিত্তের জনসংখ্যাকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকার কর্তৃক পরিচালিত “সরকারি হাসপাতাল” -উদ্দেশ্যঃ যেন প্রায় বিনামূল্যে নিন্ম শ্রেণীর মানুষজন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকেন। ঠিক তেমন একটি টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করে���েন বাংলাদেশের কথা সাহিত্যিক এবং নৃ বিজ্ঞানী শাহাদুজ্জামান । শাহাদুজ্জামানের লেখা বরাবরই একটু অন্যরকম, কিন্তু পিএইচডি থিসিসের ভাবানুবাদ সাহিত্যে প্রকাশ করা, সত্যিই অনবদ্য। একমাত্র শাহাদুজ্জামানই পারেন নিজের ডাক্তার পরিচয়টি সামলে নিয়ে একদম নিরপেক্ষ দৃষ্টীকোণ থেকে হাসপাতালের সার্বিক রুপ বৈচিত্র তুলে ধরতে। তার গবেষনায় স্থান পেয়েছে রোগী-বিধ্বস্ত হাড়,বিধ্বস্ত জীবন রোগীর আত্মীয়-স্বজন- অকূলের কূল ওয়ার্ড-বয়, ঝাড়ুদার, দারোয়ান- ক্ষুদ্র কিন্তু ক্ষমতাবান নার্স- প্রদীপবিহীন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল ডাক্তার- দম্ভ আর হতাশার যুগলবন্দী আর এই সবকিছুকে মিলিয়ে তৈরি হাসপাতাল- ক্ষুদ্র বাংলাদেশ সরকারি হাসপাতাল বলতেই আমাদের সকলের মস্তিস্কে যে ছবিটি ভেসে উঠে এবং পরিবেশ ও সেবা সম্পর্কে যেসব প্রিডিটারমাইন্ড ধারনা চলে আসে তার সবই সত্যি অথচ প্রতিটি ঘটনার একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। অনেকক্ষেত্রেই সেই নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানার পরে আমরা ঘটনা ও পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক চোখে দেখতে চেষ্টা করি। এক পাক্ষিক দোষারোপ নয় আবার অপ্রয়জনীয় আবেগের মিশ্রণও নয়। শাহাদুজ্জামানের গবেষণা পত্রটি ছিলো তেমন ই ব্যাখ্যা বহুল। কেন পড়বেন? লেখকের কথা অনুযায়ী- শরীর বিধ্যা না পড়লেও সাধারন মানুষ সকলেরই শরীর নিয়ে নিজস্ব একটি ধারনা থাকে এবং রোগের কারন নিয়েও নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা থাকে। ঠিক তেমন ই- হাসপাতালের পরিস্থিতি অনুযায়ী সকলেরই একটি নিজস্ব দোষারোপের মনোভাব লক্ষ করা যায়। সে মনোভাব পরিবর্তন এবং ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা পাবেন এই বইটির মাধ্যমে, পরিবর্তন আসবে আপনার চিন্তাধারায়। পরেরবার হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বেই বকশিশটি আলাদা করে রাখতে ভুলবেন না।
বইয়ের নামঃ একটি হাসপাতাল একজন নৃ বিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড় লেখকঃ শাহাদুজ্জামান প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারী ২০০৪
প্রথমেই আত্মসমর্পণ করে নিচ্ছি। বইপড়ার জগতে আমার এই সামান্য জ্ঞানে সামান্য অভিজ্ঞতায় লেখার মধ্যে ভুল হতে পারে। হাসপাতাল সম্পর্কে প্রবল কৌতূহল থেকেই বইটা পড়া। আমি এখনও স্কুলের গণ্ডি পার হই নি। তারপরও আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে যা অনুভব করেছি তাই লেখার চেষ্টা করছি। হাসপাতালের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর জনজীবনকে লেখক এই গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান দুর্নীতি, অনাচার, অবিচার, দুরব্যবহার, ডাক্তারদের ঊর্ধ্বতন মনোভাব, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, নার্সদের সামাজিক অবস্থা যেন বৃহত্তর জনজীবনেরই প্রতিফলক। হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির গোষ্ঠীর দাপট, রোগীদের প্রতি নার্সসহ সকলের দুরব্যবহার আমাকে ভয়ানক ভাবে আঘাত করেছে। অথচ কত হতাশা, জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আশার আলোর খোঁজে তারা হাসপাতালে থাকে দিনের পর দিন। কারো জীবনেরই নিশ্চয়তা নেই। হাস্পাতালে আসা রোগীরা মূলত সমাজেরই একটি অংশ। হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা নীতিহীন কর্মকাণ্ডসমুহ বাংলা��েশের সমাজেরই একটি বৃহৎ চিত্র অংকন করছে। এবং লেখক বইয়ের শেষাংশে এসবের পেছনের কারণগুলো অত্যন্ত সুন্দরভাবে একপেশে মনোভাব পোষণ না করে বিশ্লেষণ করেছেন। বইটি পাঠককে বাংলাদেশে চলমান রাজনীতির অসহায়ত্ব এবং সর্বোপরি বর্তমান বাংলাদেশের 'এই' অবস্থান সম্পর্কে ভাববার মতো কিছু সুযোগ সৃষ্টি করে দিবে এবং পরিশেষে এক অন্যরকম হাহাকার আর হতাশায় মুড়িয়ে দিয়ে যাবে।
‘একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়’ বইটি এককথায় অনবদ্য। অনবদ্য আমার কাছে এই কারণে বইটি একটা থিসিস পেপার অথচ পড়তে গিয়ে একবারও মনে হয় নি থিসিসের ভাষা এত সহজ হতে পারে সরল হতে পারে এবং থিসিস যেহেতু তথ্য নির্ভর হয় এবং ছোটখাটো তথ্য পড়তে বিরক্ত লাগাটা স্বাভাবিক অথচ থিসিসটাকে শাহাদুজ্জামান এককথায় সুখপাঠ্য করে তুলে অনবদ্য করেছেন। আমাদের দেশের হাসপাতালকে ঘিরে সাধারণ মানুষের আছে নানা প্রত্যাশা এবং একই সাথে ক্ষোভ। সশরীর পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে লেখা এই বইয়ে চিকিৎসক, নার্স, রোগী রোগীর আত্মীয়, ওয়ার্ডবয়, ঝাড়ুদার ,দারোয়ান নিয়ে গড়ে ওঠা হাসপাতাল জীবনকে পোর্ট্রেট করেছেন শাহাদুজ্জামান।
তিনি দেখিয়েছেন কী করে হাসপাতালের জীবন আসলে বাংলাদেশের বৃহত্তর সমাজের নানা বৈশিষ্ট্যকেই প্রতিফলিত করেছে। কী করে হাসপাতালের একটি ওয়ার্ড হয়ে উঠেছে একটি ক্ষুদ্র বাংলাদেশ। বইটি একজন নৃবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে একটি হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ হলেও শেষমেষ যেন সেটা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রতিবিম্ব।
হাসপাতাল নিয়ে আমার আগ্রহ বহুকালের। সেই আগ্রহের খুঁটিনাটি অনেকটা জানতে পারলাম একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড় বইটি পড়ে।
বইটা মূলত লেখক সাহেবের পি এইচ ডি অভিসন্দর্ভের বাংলা অনুবাদ। অ্যাকাডেমিক থিসিসটি একদম হুবহু অনুবাদ করা হয়নি, প্রবন্ধের চরিত্র ঠিক রেখেই রূপান্তরটি করা হয়েছে। সেজন্যই পড়ার সময় একদমই কাঠখোট্টা মনে হবে না। অবশ্য, বিষয়বস্তু এত আকর্ষনীয় যে বইটা পড়বার সময় বিরক্ত হবার সুযোগ একেবারেই নেই।
বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে থাকার অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে তারা বইয়ের প্রতিটা বিষয়ই রিলেট করতে পারবেন। বইতে লেখক শুধু বাংলাদেশের হাসপাতালের বিবরণই নয়, হাসপাতালের কর্মচারী, ডাক্তার, নার্স, রোগী, রোগীর অ্যাটেন্ডেট সবারই কথা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, অপারগতা সহ নানাদিক উঠে এসেছে। লেখক নিজে ডাক্তার হবার পরেও পক্ষপাতিত্ব দেখাননি। নির্মোহভাবেই একটি হাসপাতালের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। বেশিরভাগ সময়েই লেখার পরিধি হাসপাতালের গণ্ডী ছাড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং তাদের মানসিকতা পর্যন্ত ঘুরে এসেছে।
ইংরেজিতে বিবিধ বিষয় নিয়ে উপভোগ্য নন ফিকশন প্রচুর লেখা থাকলেও বাংলায় সেরকম নেই। বাংলা প্রবন্ধ মানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাঠখোট্টা জ্ঞানের কচকচানি। এই বইটি সেক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম।