Shanin Hoque 's Reviews > একজন কমলালেবু

একজন কমলালেবু by Shahaduz Zaman
Rate this book
Clear rating

by
113080635
's review

it was amazing

'জীবনানন্দ দাশ' মায়ের অমায়িক আদর্শ ছেলে,বাংলা সাহিত্যের নির্জনতম-শুদ্ধতম কবি হিসেবে জনশ্রুত ।তবে, 'জীবনানন্দ' শুধুই কি একজন মানবসন্তান অথবা কবির নাম?নাকি এক জীবনবোধের নাম ? বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান ধানসিঁড়ি তীরের কবি জীবনানন্দ দাশকে আদ্যোপান্ত দারুণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ।ফলশ্রুতিতে, 'একজন কমলালেবু' বইয়ের পাতায় পাতায় ধরা দিয়েছে জীবনানন্দের জীবন রহস্য!

বই : একজন কমলালেবু
লেখক : শাহাদুজ্জামান
প্রকাশনা : প্রথমা
প্রকাশনা সাল : ২০১৭
মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা

সময়পঞ্জিকার পাতা উল্টিয়ে নতুন শতক যখন আগমনের অপেক্ষায় ঠিক সেই ক্ষণে বরিশালের এক শিক্ষিত-মার্জিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ছোট্ট শিশু 'মিলু'। বোধ করি, মাতা কুসুমকুমারী দাশ-ও (তৎকালীন সময়ের সুপরিচিত কবি) আঁচ করতে পারেননি তাঁর 'মিলু' তাঁর কাছ থেকে কাব্যসাধনায় প্রভাবিত হয়ে, শব্দ খেলায় অনুপ্রাণিত হয়ে একদিন বাংলা কাব্যসাহিত্যের উচ্চস্থানে আসীন হবে।জীবনানন্দ স্বয়ং কি সে আশায় আশাবাদী ছিলেন ? কেন-ইবা তাঁর জীবনানন্দ নামের আড়ালে আজীবন ছিলো জীবনের আনন্দের প্রগাঢ় অনুপস্থিতি?! সেই প্রশ্নের উত্তর-ই শাহাদুজ্জামান তত্ত্ব আর তথ্যের সমন্বয়ে দিয়ে গেছেন বইটির ২৩৮ টি পাতা জুড়ে।

দুইশতাধিক পৃষ্ঠার এই জীবনচরিতে একজন সাধারণ-সাদামাটা বাঙালি যুবকের কবি হয়ে ওঠার গল্প,কারণে কিংবা অকারণে পদে পদে ব্যর্থ হয়েও কবিত্বকে শাণিত করে যাবার আখ্যান,সর্বস্ব খুঁইয়ে-ও নিজের কবি সত্তার জন্যে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাওয়া এবং
হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও কবিতাকে আঁকড়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টার বিবরণ উঠে এসেছে।

পঞ্চাশের কিছু বেশি বছর এই ধূলির ধরায় কাটিয়ে গেলেন জীবনানন্দ কিন্তু স্বস্তি কি পেলেন?লিখে রেখে গেলেন অজস্র চিত্ররূপময় কবিতা কিন্তু জীবনের টানাপোড়েন তো সে-ই রয়েই গেলো। কল্পনায় পৃথিবীর পথে হাজার বছর হেঁটে আগন্তুক বনলতার কাছে আজন্মের আকাঙ্ক্ষিত দু-দণ্ড শান্তির সন্ধান পেয়েছিলেন বটে ;তবে বাস্তবিক পৃথিবীতে সে বোধ অস্তিত্বহীন- কেবলই মায়া!গোটা জীবন ধরে কাব্য-উপন্যাস-প্রবন্ধে যে মুক্তির সন্ধান করে গেলেন সে মুক্তি তাঁর কাছে চির অধরা-ই রয়ে গেলো। সে অধরা থাকবার-ই তো কথা!
একটা গোটা জীবনের অজস্র অমূল্য দিনরাত্রি যে সৃষ্টিকর্মের পেছনে ব্যয় করেছেন তিনি তার বেশ অনেকটুকুই তো পাঠকমহলের যথার্থ মূল্যায়ন না পেয়ে অপ্রকাশিত রেখেছিলেন ; গোপনে বাক্সবন্দী করে রেখেছিলেন জীবনভর। দিনের পর দিন অভিমানী কবির সেসব অমূল্য সৃষ্টি জীর্ণ বাক্সে বন্দী থাকতে থাকতে পরিণত হয় ধূসর পান্ডুলিপিতে। কিন্তু,তাঁর মনে ক্ষীণ আশা ছিলো যে তাঁর অসামান্য প্রতিভা একদিন স্বীকৃতি পাবেই। মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্টিরা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে - এই ছিলো তাঁর গহন জ্ঞান। তাঁর রচনাতেই সেই সুপ্ত আশার প্রকাশ ঘটেছিলো এভাবে -
"ঠিক করেছি,আমি যখন খুশি কবিতা লিখবো কিন্তু কাউকে তা দেখাতে যাবো না।তবে কবিতাগুলো না ছিঁড়ে জমিয়ে রেখেছি ; সেগুলো কোনো না কোনো হৃদয়কে কোনো না কোনো দিন আলো দেখাবে ; জলের কণিকাদের আঘাতের মতো ঘরোয়া প্রতীকের আশ্রয়ে সমাজকে বহন করে ফিরতে ; কথা ভাবাবে তারপরেও কথা ভাবাবে- অনেক কাল....."

কিছু টুকরো আশা - অভিলাষা ; অনেকখানি হতাশা-নিরাশা নিয়ে যখন নিরানন্দে জীবন কাটাচ্ছিলেন জীবনানন্দ তখন তাঁর জীবনে সাগরসম দুঃখ নিয়ে এলো 'দেশভাগ'। অকস্মাৎ শেকড় ছেড়ে পাড়ি জমাতে হলো ইট-কাঠ-পাথরের কলকাতা শহরে।কেবলমাত্র ধর্মপরিচয়ের কারণে প্রকৃতিপ্রেমী নির্জনতম মানুষটি চিরচেনা মফস্বল শহর বরিশাল, কাশ-বেতফুল-হোগলার বন - প্রাণপ্রিয় ধানসিঁড়ি নদী ছেড়ে এক সাগর দুঃখভরা বুক-শূণ্যতাঘেঁষা অস্তিত্ব নিয়ে নির্বাক-হতভম্ব হয়ে চিরতরে নির্বাসিত হলেন কলকাতায়।এক জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটা বোধহয় তখন-ই পেয়েছিলেন কবি। সেজন্যেই তাঁর কবিতায় বারবার শেকড়ে ফেরার আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে ; বাংলার প্রতি তীব্র অনুরাগময় ভাবাবেগ প্রস্ফুটিত হয়েছে। বাংলার অপরূপ প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ জীবনানন্দ ক্ষণে ক্ষণে ফিরে আসতে চেয়েছেন তার প্রিয় স্বদেশের ধানসিঁড়ির তীরে মানুষ অথবা শঙ্খচিল কিংবা শালিক পাখির বেশে, কখনো হতে চেয়েছেন ভোরের কাক-সুদর্শন পোকা নতুবা কিশোরী মেয়ের পায়ের নূপুর;দাঁড়াতে চেয়েছেন কার্তিকের নবান্নের দেশে;জিরিয়ে নিতে চেয়েছেন কাঁঠালছায়ায়!

তারপর,অসীম দুঃখের সাথে যুঝতে যুঝতে একদিন জীবনানন্দ চলে গেলেন! রেখে গেলেন একজন কমলালেবুর করুণ উপাখ্যান -

"একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোন এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানার কিনারে!"

তবে,দিনশেষে যে জীবনানন্দের ক্ষীণ আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পেয়েছে এ-ই পরম আনন্দের বিষয়।অপ্রকাশিত ধূসর পান্ডুলিপিসমূহ প্রকাশ্যে এসে সর্বজন নন্দিত হয়েছে,মায়াময় শব্দে রচিত চিত্র-রূপময় কবিতাগুলো আজ তাঁকে বরেণ্য করেছে।প্রচলিত কাব্যবলয় ভেঙে সে যুগে অক্ষরে অক্ষরে যে আধুনিকতার স্বাদ পাঠকশ্রেণিকে দিতে চেয়েছিলেন তার মর্ম পাঠকমহল ষোল আনা টের পেয়েছে। জীবনকালে যে সম্মানের আশায় আকুল হয়ে ছিলেন সে সম্মান জীবন শেষে বহুগুণ ভারী হয়ে এসেছে। কালের ঊর্ধ্বে গিয়েও এই নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর হয়ে রইলেন বাংলার আধুনিকতম কবি 'জীবনানন্দ দাশ'।

এভাবেই পাতায় পাতায় ছোট্ট মিলুর খ্যাতনামা কবি জীবনানন্দ হয়ে ওঠার চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প বলেছেন লেখক শাহাদুজ্জামান। গোটা বইটাকে লেখক বেশ কিছু পরিচ্ছদে বিভক্ত করে সযত্নে সহজ শব্দে রচনা করেছেন। বইটি পড়তে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, লেখক বহুদিন ধরে জীবনানন্দের জীবনরহস্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন ; বিভিন্ন তথ্যভাণ্ডার থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্যসমূহ সংগ্রহ করে তারপর হাত দিয়েছেন গ্রন্থরচনায়।লেখকের নিপুণ শব্দশৈলী আর ভাষাগত মাধুর্যের কারণেই এই বইটি কোনো আটপৌরে রষ-কষহীন জীবনচরিত বলে মনে হয়নি আমার। বইটিতে কোনো বানান বিভ্রাট তো ছিলো-ই না বরং সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই দেখে যে বইটিতে প্রতিটি বাংলা শব্দ বাংলা অক্ষরে এবং ইংরেজি শব্দ ইংরেজি অক্ষরে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাই,জীবনানন্দ দাশের জীবনপথের বহু চোরাগলির খোঁজ পেতে চাইলে পড়তে পারেন 'একজন কমলালেবু' !
12 likes · flag

Sign into Goodreads to see if any of your friends have read একজন কমলালেবু.
Sign In »

Reading Progress

April 10, 2021 – Started Reading
April 10, 2021 – Shelved as: to-read
April 10, 2021 – Shelved
April 25, 2021 – Finished Reading

Comments Showing 1-1 of 1 (1 new)

dateDown arrow    newest »

message 1: by Mahrufa (new)

Mahrufa Mery খুব সুন্দর করে রিভিউ লিখেছেন।


back to top