সঠিকতা ও সূক্ষ্মতা
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতে ব্যবহৃত পরিমাপ ব্যবস্থার সঠিকতা, নির্ভুলতা, অভ্রান্ততা বা ভ্রমশূন্যতা বলতে কোনও রাশির পরিমাপকৃত মানগুলির সাথে রাশিটির প্রকৃত মান তথা বাস্তবিকভাবে সত্য মানের (কিংবা কোনও নির্দেশ মানের) নৈকট্যকে বোঝায়।[১] কোনও পরিমাপ ব্যবস্থার সূক্ষ্মতা, স্পষ্টতা, সুসামাঞ্জস্য বা সুসংহতি (কদাচিৎ যথার্থতা ও যথাযথতা-ও বলা হয়) বলতে অপরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে কোনও রাশিকে বারংবার পরিমাপ করে প্রাপ্ত মানগুলির একে অপরের সাপেক্ষে নৈকট্যকে বোঝায়। অর্থাৎ সূক্ষ্মতার ধারণাটি রাশির প্রকৃত সত্য মান নয়, বরং পৌনঃপুনিক পরিমাপে একই মান পুনরুৎপাদিত হচ্ছে কি না, অর্থাৎ পরিমাপের পৌনঃপুনিকতা ও পরিমাপকৃত মানের পুনরুৎপাদনযোগ্যতার ধারণাগুলির সাথে জড়িত।[১][২]
সাধারণভাবে সঠিকতা হল নিয়মানুগ ত্রুটির একটি বর্ণনা ও পরিসংখ্যানিক পক্ষপাতদুষ্টতার বিপরীত একটি পরিমাপ। সঠিকতা কম হলে পরিমাপকৃত মান ও সত্য মানের (বা নির্দেশ মানের) মধ্যে বেশি পার্থক্য থাকে। অন্যদিকে সূক্ষ্মতা হল সমসম্ভব ত্রুটির বর্ণনা ও পরিসংখ্যানিক ভেদের বিপরীত একটি পরিমাপ। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যায় "সঠিকতা" ও "সূক্ষ্মতা" পরিভাষাগুলি বেশি ব্যবহৃত হয়, আর পরিসংখ্যান শাস্ত্রে "পক্ষপাত" ও "ভেদ" পরিভাষাগুলি বেশি ব্যবহৃত হয়।
আরও সহজ ভাষায় বললে একই রাশিকে বারংবার পরিমাপ করার পরে প্রাপ্ত উপাত্তগুলির গড় মান যদি রাশিটির প্রকৃত মান অর্থাৎ বাস্তবিকভাবে সত্য মানের অনেক কাছাকাছি হয়, তাহলে বলা হয় এই রাশিটির পরিমাপ অনেক সঠিক (বা নির্ভুল বা অভ্রান্ত বা ভ্রমশূন্য) হয়েছে। আর একই রাশিকে বারংবার পরিমাপ করে প্রাপ্ত মানগুলি যদি একে অপরের অনেক কাছাকাছি হয়, তাহলে বলা হয় যে রাশিটির পরিমাপ অনেক সূক্ষ্ম (বা সুসমঞ্জস বা সুসংহত) হয়েছে।
সঠিকতা ও সূক্ষ্মতার ধারণা দুইটি একে অপর থেকে স্বতন্ত্র, তাই একটি পরিমাপকৃত উপাত্তের সংগ্রহ বা সেট চার রকম হতে পারে: ১) সঠিক কিন্তু সূক্ষ্ম নয়, ২) সূক্ষ্ম কিন্তু সঠিক নয়, ৩) একাধারে সঠিক ও সূক্ষ্ম, এবং ৪) সঠিক বা সূক্ষ্ম কোনওটিই নয়। যেমন যদি কোনও পরিমাপকারী ব্যবস্থাতে নিয়মানুগ ত্রুটি থাকে তাহলে নমুনা সংখ্যা বৃদ্ধি করলে সূক্ষ্মতা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু সঠিকতা বৃদ্ধি পায় না। এক্ষেত্রে পরিমাপকৃত মানগুলি আরও বেশি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে বা সূক্ষ্মতর পার্থক্যবিশিষ্ট হবে, কিন্তু ব্যবস্থাটির সঠিকতায় কোনও হেরফের হবে না। আবার নমুনা সংখ্যা না বাড়িয়ে যদি নিয়মানুগ ত্রুটিটিকে দূর করে দেওয়া যায়, তাহলে সঠিকতা বাড়বে কিন্তু সূক্ষ্মতার কোনও পরিবর্তন হবে না।
তবে সঠিকতা ও সূক্ষ্মতার এই সাধারণ সংজ্ঞার সাথে আন্তর্জাতিক আদর্শ নির্ধারণী সংস্থা আইএসও-র সংজ্ঞার পার্থক্য আছে। উপরে সংজ্ঞায়িত "সঠিকতা"-র জন্য তারা "সত্যতা" পরিভাষাটি ব্যবহার করে থাকে। আইএসও-এ মতে "সঠিকতা" হল নিয়মানুগ ত্রুটি ও সমসম্ভব ত্রুটি, এই উভয় ধরনের পরিমাপগত ত্রুটি-র (পর্যবেক্ষণগত ত্রুটির) সামষ্টিক প্রভাব বর্ণনাকারী একটি ধারণা। সুতরাং আইএসও-সংজ্ঞায়িত "সঠিকতা" উচ্চ হতে হলে "সত্যতা" ও সূক্ষ্মতা উভয়কেই উচ্চ হতে হয়।
উদাহরণ
[সম্পাদনা]ধরা যাক, কোনও ব্যক্তির প্রকৃত (বাস্তবিকভাবে সত্য) ওজন ৭০.০০ কিলোগ্রাম। এখন ব্যক্তিটি একটি ওজন মাপার যন্ত্র ক দিয়ে নিজের ওজন তিন বার মেপে ওজন পেলেন ৭০.২ কিলোগ্রাম, ৭০.৯ কিলোগ্রাম ও ৭০.১ কিলোগ্রাম, যে ওজনগুলির গড় মান (৭০.২ + ৭০.৯ + ৭০.১)/৩= ৭০.৪ কিলোগ্রাম, যার সাথে প্রকৃত ওজনের ব্যবধান ০.৪ কিলোগ্রাম। এখন ব্যক্তিটি দ্বিতীয় একটি ওজন মাপার যন্ত্র খ দিয়ে নিজের ওজন আবার তিন বার মেপে ওজন পেলেন ৭০.৭ কিলোগ্রাম, ৭০.৬ কিলোগ্রাম ও ৭০.৮ কিলোগ্রাম, যাদের গড় মান (৭০.৭ + ৭০.৬ + ৭০.৮)/৩= ৭০.৭ কিলোগ্রাম, যার সাথে প্রকৃত ওজনের ব্যবধান ০.৭ কিলোগ্রাম। সুতরাং এই উদাহরণে ক ওজন মাপার যন্ত্রটির সঠিকতা খ ওজন মাপার যন্ত্রটির তুলনায় বেশি।
এখন ক ওজন মাপার যন্ত্র দ্বারা পরিমাপকৃত ওজন তিনটির গড় (৭০.৪ কিলোগ্রাম) থেকে প্রতিটি স্বতন্ত্র ওজনের পরম বিচ্যুতি হল যথাক্রমে ০.২ কিলোগ্রাম, ০.৫ কিলোগ্রাম, ০.৩ কিলোগ্রাম; সুতরাং গড় ওজন থেকে ওজনগুলির গড় বিচ্যুতি হল (০.২+০.৫+০.৩)/৩= ০.৩৩ কিলোগ্রাম। আবার খ ওজন মাপার যন্ত্র দ্বারা পরিমাপকৃত মান তিনটির গড় (৭০.৭ কিলোগ্রাম) থেকে প্রতিটি ওজনের পরম বিচ্যুতি হল যথাক্রমে ০.০ কিলোগ্রাম, ০.১ কিলোগ্রাম, ০.১ কিলোগ্রাম; সুতরাং গড় ওজন থেকে ওজনগুলির গড় বিচ্যুতি হল (০.০ + ০.১ + ০.১)/৩= ০.০৬ কিলোগ্রাম। সুতরাং ক ওজন মাপার যন্ত্রের তুলনায় খ ওজন মাপার যন্ত্রটির মানগুলির গড় বিচ্যুতি অনেক কম (০.০৬ < ০.৩৩), অন্য ভাষায় খ ওজন মাপার যন্ত্রের পরিমাপকৃত ওজন তিনটি একে অপরের অনেক বেশি কাছাকাছি অবস্থিত, সুতরাং খ ওজন মাপার যন্ত্রের সূক্ষ্মতা ক ওজন মাপার যন্ত্রের তুলনায় বেশি।
সামগ্রিকভাবে উপরের উদাহরণে ক ওজন মাপার যন্ত্রটি বেশি সঠিক, কিন্তু কম সূক্ষ্ম। অপরপক্ষে খ ওজন মাপার যন্ত্রটি কম সঠিক, কিন্তু বেশি সূক্ষ্ম।
পরিভাষা (বাংলা বর্ণানুক্রমে)
[সম্পাদনা]- অভ্রান্ততা - accuracy
- গড় বিচ্যুতি - average deviation
- নমুনা সংখ্যা - sample size
- নিয়মানুগ ত্রুটি - systematic error
- নির্দেশ মান - reference value
- নির্ভুলতা - accuracy
- পরিমাপগত ত্রুটি - measurement error
- পরিসংখ্যানিক পক্ষপাত - statistical bias
- পরিসংখ্যানিক ভেদ - statistical variability
- পর্যবেক্ষণগত ত্রুটি - observational error
- পুনরুৎপাদনযোগ্যতা - reproducibility
- পৌনঃপুনিকতা - repeatability
- ভ্রমশূন্যতা - accuracy
- যথাযথতা - precision
- যথার্থতা - precision
- সঠিকতা - accuracy
- সত্য মান- true value
- প্রকৃত মান - true value
- পরম বিচ্যুতি - absolute deviation
- সত্যতা - trueness
- সমসম্ভব ত্রুটি - random error
- সূক্ষ্মতা - precision
- সুসংহতি - precision
- সুসামঞ্জস্য - precision
- স্পষ্টতা - precision
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ JCGM 200:2008 International vocabulary of metrology — Basic and general concepts and associated terms (VIM)
- ↑ Taylor, John Robert (১৯৯৯)। An Introduction to Error Analysis: The Study of Uncertainties in Physical Measurements। University Science Books। পৃষ্ঠা 128–129। আইএসবিএন 0-935702-75-X।