নেপচুন-পরবর্তী গ্রহসমূহ
১৮৪৬ সালে নেপচুন গ্রহ আবিষ্কারের পর এই গ্রহের কক্ষপথের অপর পারে আরেকটি গ্রহ রয়েছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট জল্পনাকল্পনা শুরু হয়। এই কল্পিত গ্রহটির অনুসন্ধান শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনাকালেও পার্সিভাল লোয়েলের এক্স গ্রহের (ইংরেজি: Planet X) অনুসন্ধানের মাধ্যমে তা অব্যাহত থাকে। দানব গ্রহগুলির (নির্দিষ্টভাবে ইউরেনাস ও নেপচুনের) কক্ষপথে যে আপাত বৈষম্য দেখা যায় তা ব্যাখ্যা করতে লোয়েল এক্স গ্রহ অনুকল্পটি প্রস্তাব করেন।[১] তিনি অনুমান করেছিলেন, একটি বৃহৎ অদৃষ্টপূর্ব নবম গ্রহের অভিকর্ষীয় বল ইউরেনাসকে যথেষ্ট পরিমাণে উত্তেজিত করে এই ধরনের বৈষম্য ঘটাচ্ছে।[২]
১৯৩০ সালে ক্লাইড টমবাও কর্তৃক প্লুটো আবিষ্কৃত হলে লোয়েলের অনুকল্পটি আপাতদৃষ্টিতে বৈধ প্রমাণিত হয়। প্লুটোকেও আনুষ্ঠানিকভাবে নবম গ্রহ নাম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্লুটোর অভিকর্ষীয় বল যে কোনও দানব গ্রহকে প্রভাবিত করার পক্ষে অত্যন্ত কম তা ১৯৭৮ সালে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। যার ফলে দশম গ্রহের এক স্বল্পকালীন অনুসন্ধান শুরু হয়। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভয়েজার ২ মহাকাশযান কর্তৃক সংগৃহীত পরিমাপগুলি পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, পরিগণনা কালে নেপচুনের ভর সামান্য বেশি ধরার কারণেই ইউরেনাসের কক্ষপথে সেই অসমতা পর্যবেক্ষিত হয়েছিল। এর পর দশম গ্রহের অনুসন্ধান অনেকাংশে পরিত্যক্ত হয়।[৩] ১৯৯২ সালের পরে প্লুটোর সমরূপ অথবা তদপেক্ষাও বৃহত্তর কক্ষপথে অসংখ্য ছোটো ছোটো তুষারাবৃত বস্তু আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্লুটোকে আর গ্রহের মর্যাদা দেওয়া উচিত কিনা অথবা প্লুটো ও তার প্রতিবেশীগুলিকে গ্রহাণুর মতো স্বতন্ত্র কোনও শ্রেণিভুক্ত করা উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এই গোষ্ঠীর একাধিক বৃহত্তর সদস্য ইতিপূর্বে গ্রহ হিসেবে বর্ণিত হলেও ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (আইএইউ) প্লুটো ও তার বৃহত্তম প্রতিবেশীগুলিকে বামন গ্রহ হিসেবে নতুনভাবে শ্রেণিভুক্ত করে। এর ফলে নেপচুন সৌরজগতের দূরতম জ্ঞাত গ্রহে পরিণত হয়।[৪]
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সমাজের বৃহত্তর অংশ এই বিষয়ে একমত যে, প্রাথমিকভাবে যে এক্স গ্রহের কল্পনা করা হয়েছিল তার বাস্তব অস্তিত্ব নেই। অবশ্য কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বাহ্য সৌরজগতে পর্যবেক্ষিত অন্যান্য ব্যতিক্রমগুলিকে ব্যাখ্যা করতে অদ্যাবধি অপর্যবেক্ষিত এক গ্রহের ধারণাটিকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।[৫] ২০১৪ সালের মার্চ মাসের হিসেব অনুযায়ী, ওয়াইজ দূরবীনের মাধ্যমে পরিচালিত পর্যবেক্ষণ ১০,০০০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককে শনির আকারবিশিষ্ট (৯৫ পার্থিব ভর) কোনও বস্তু এবং ২৬,০০০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককে বৃহস্পতির আকারবিশিষ্ট (≈৩১৮ পার্থিব ভর) বা তার চেয়েও বড়ো কোনও বস্তুর সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছে।[৬]
২০১৪ সালে সম্প্রতি-আবিষ্কৃত চরম নেপচুনোত্তর বস্তুগুলির একটি গোষ্ঠীর কক্ষপথের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি অতি-পৃথিবী গ্রহের অস্তিত্বের অনুকল্পনা করেছেন। এই গ্রহটির ভর পৃথিবীর ভরের তুলনায় ২ থেকে ১৫ গুণ বেশি এবং অবস্থায় ২০০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককের ওপারে, সম্ভবত ১,৫০০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককে একটি অতিমাত্রায় আনত কক্ষপথে।[৭] ২০১৬ সালে আরও গবেষণার ফলে জানা যায় যে, এই অজ্ঞাত দূরবর্তী গ্রহটি এমন এক আনত ও উৎকেন্দ্রিক কক্ষপথে অবস্থিত যেটি সূর্য থেকে ২০০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককের চেয়ে কাছে এবং ১,২০০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককের চেয়ে দূরে অবস্থিত নয়। বৈজ্ঞানিকদের অগ্রকথন অনুযায়ী, এই কক্ষপথ গুচ্ছবদ্ধ চরম নেপচুনোত্তর বস্তুগুলির সঙ্গে একই সরলরেখায় বিন্যস্ত নয়।[৮] আইএইউ যেহেতু প্লুটোকে আর গ্রহের মর্যাদা দেয় না, সেই হেতু এই নতুন অনুকল্পিত বস্তুটি পরিচিতি লাভ করে নবম গ্রহ হিসেবে।[৯]
প্রারম্ভিক অনুমান
[সম্পাদনা]১৮৪০-এর দশকে ফরাসি গণিতজ্ঞ উরবেঁ লে ভেরিয়ে ইউরেনাসের কক্ষপথের উত্তেজনার বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করতে নিউটনীয় বলবিদ্যার প্রয়োগ ঘটান এবং এক তদবধি-অনাবিষ্কৃত গ্রহের অভিকর্ষীয় আকর্ষণকে এই উত্তেজনার কারণ বলে অনুকল্পনা করেন। লে ভেরিয়ে এই নতুন গ্রহটির অবস্থানের অগ্রকথন করেন এবং নিজের গণনার ফলাফল জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান গটিফ্রেড গেলের কাছে পাঠিয়ে দেন। চিঠিটি পাওয়ার ঠিক পরের রাতে অর্থাৎ ১৮৪৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গেল ও তাঁর ছাত্র হেইনরিখ ড্যারে ঠিক যেখানে লে ভেরিয়ার গ্রহটির অবস্থানের অগ্রকথন করেছিলেন সেখানেই নেপচুন আবিষ্কার করেন।[১০] দানব গ্রহগুলির কক্ষপথে কয়েকটি ছোটোখাটো বৈষম্য ছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এই বৈষম্যগুলি নেপচুনের পরেও আরেকটি গ্রহের অস্তিত্বের ইঙ্গিত।
নেপচুন আবিষ্কারের আগেও কোনও কোনও বৈজ্ঞানিক অনুমান করেছিলেন এই বৈষম্যের কারণ ব্যাখ্যা কোনও একটি গ্রহের অস্তিত্ব যথেষ্ট নয়। ১৮৩৪ সালের ১৭ নভেম্বর ব্রিটিশ অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী রেভারেন্ড টমাস জন হাসে ব্রিটিশ রাজ-জ্যোতির্বিজ্ঞানী জর্জ বিডেল এয়ারির কাছে ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যালেক্সিস বোভার্দের সঙ্গে তাঁর একটি কথোপকথনের কথা জানিয়েছিলেন। হাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি যখন বোভার্দকে বলেন যে ইউরেনাসের অস্বাভাবিক গতির কারণ সম্ভবত একটি অনাবিষ্কৃত গ্রহের অভিকর্ষীয় প্রভাব, তখন বোভার্দ বলেছিলেন যে এমন কথা তাঁরও মনে হয়েছে এবং এই বিষয়ে তিনি গোথায় সিবার্গ মানমন্দিরের অধিকর্তা পিটার আন্দ্রেয়াস হানসেনের সঙ্গে চিঠিপত্র আদানপ্রদান করেছেন। হানসেনের মত ছিল যে, ইউরেনাসের গতি ব্যাখ্যায় কোনও একটি বস্তুর উপস্থিতি যথেষ্ট নয়। তিনি যুক্তির খাতিরে ইউরেনাসের পরে দু’টি গ্রহের অস্তিত্ব অনুমান করেছিলেন।[১১]
১৮৪৮ সালে জাক ব্যাবিনে লে ভেরিয়ের গণনা নিয়ে একটি আপত্তি উত্থাপন করেন। তিনি দাবি করেন যে, লে ভেরিয়ে প্রাথমিকভাবে যা অগ্রকথন করেছিলেন তার তুলনায় নেপচুনের পর্যবেক্ষিত ভর কম এবং কক্ষপথটি বৃহত্তর। লে ভেরিয়ের গণনার থেকে সাধারণ বিয়োগের ভিত্তিতে তিনি এই মত প্রকাশ করেন যে, নেপচুনের পরে মোটামুটি ১২ পার্থিব ভরের আরেকটি গ্রহের অস্তিত্ব অবশ্যই রয়েছে এবং তিনি গ্রহটির নামকরণ করেন "হাইপেরিয়ন"।[১১] লে ভেরিয়ের অনুকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করে ব্যাবিনে বলেন যে, "অতিমাত্রায় কল্পনাপ্রবণ একটি অনুকল্পনা ছাড়া আর এমন কিছুই নেই যার দ্বারা অপর গ্রহটির অবস্থান নির্ধারণ করা যায়।"[১১]
১৮৫০ সালে ইউনাইটেড স্টেটস ন্যাভাল অবজারভেটারির সহকারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস ফার্গুসন উল্লেখ করেন যে তাঁর পর্যবেক্ষিত একটি নক্ষত্র তিনি "হারিয়ে ফেলেছেন"। জিআর১৭১৯কে (ইংরেজি: GR1719k) নামাঙ্কিত এই নক্ষত্রটিকেই মানমন্দিরের অধীক্ষক লেফট্যানেন্ট ম্যাথিউ মরি নতুন এক গ্রহের প্রমাণ হিসেবে দাবি করেন। একটি ভিন্ন অবস্থানে "গ্রহ"টিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য পরবর্তী অনুসন্ধানগুলি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৮৭৮ সালে নিউ ইয়র্কের হ্যামিলটন কলেজ মানমন্দিরের পরিচালক সিএইচফ পিটারস দেখিয়ে দেন যে, নক্ষত্রটি আসলে অদৃশ্য হয়ে যায়নি, বরং পূর্ববর্তী ফলাফলগুলি পাওয়া গিয়েছিল পর্যবেক্ষকেরই ভুলে।[১১]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;bower
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ টমবাও (১৯৪৬), পৃ. ৭৩।
- ↑ টম স্ট্যান্ডেজ (২০০০)। দ্য নেপচুন ফাইলস: আ স্টোরি অফ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল রাইভালরি অ্যান্ড দ্য পায়োনিয়ারস অফ প্ল্যানেট হান্টিং। নিউ ইয়র্ক: ওয়াকার। পৃষ্ঠা ১৮৮। আইএসবিএন 978-0-8027-1363-6। অজানা প্যারামিটার
|1=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য) - ↑ "আইএইউ ২০০৬ জেনারেল অ্যাসেম্বলি: রেজোলিউশনস ৫ অ্যান্ড ৬" [আইএইউ ২০০৬ সাধারণ সভা: ৫ ও ৬ নং সিদ্ধান্ত] (পিডিএফ)। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন। ২০০৬-০৮-২৪।
- ↑ এস. সি. টেগলার; ডব্লিউ. রোমানিশিন (২০০১)। "অলমোস্ট প্ল্যানেট এক্স" [প্রায় এক্স গ্রহ]। নেচার। ৪১১ (৬৮৩৬): ৪২৩–৪২৪। এসটুসিআইডি 5135498। ডিওআই:10.1038/35078164 । পিএমআইডি 11373654। অজানা প্যারামিটার
|name-list-style=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য) - ↑ লুহ্ম্যান, কে. এল. (২০১৪)। "আ সার্চ ফর আ ডিসটেন্ট কমপ্যানিয়ন টু দ্য সান উইথ দি ওয়াইড-ফিল্ড ইনফ্রারেড সার্ভে এক্সপ্লোরার" [ওয়াইড-ফিল্ড ইনফ্রারেড সার্ভে এক্সপ্লোরারের সঙ্গে সূর্যের এক দূরের সঙ্গীর অনুসন্ধান]। দি অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল। ৭৮১ (১): ৪। ডিওআই:10.1088/0004-637X/781/1/4। বিবকোড:2014ApJ...781....4L।
- ↑ ট্রুজিলো, সি. এ.; শেপার্ড, এস. এস. (২০১৪)। "আ সেডনা-লাইক বডি উইথ আ পেরিহেলিয়ন অফ ৮০ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিটস" [৮০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক-বিশিষ্ট অনুসুর-যুক্ত একটি সেডনা-সদৃশ বস্তু] (পিডিএফ)। নেচার। ৫০৭ (৭৪৯৩): ৪৭১–৪৭৪। এসটুসিআইডি 4393431। ডিওআই:10.1038/nature13156। পিএমআইডি 24670765। বিবকোড:2014Natur.507..471T। ২০১৪-১২-১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০১-২৫।
- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;AJ121-2-22
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ বারডিক, অ্যালান (২০ জানুয়ারি ২০১৬)। "ডিসকভারিং প্ল্যানেট নাইন" [নবম গ্রহ আবিষ্কার]। দ্য নিউ ইয়র্কার। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০১৬।
- ↑ ক্রসওয়েল (১৯৯৭), পৃ. ৪৩
- ↑ ক খ গ ঘ মর্টন গ্রসার (১৯৬৪)। "দ্য সার্চ ফর আ প্ল্যানেট বিয়ন্ড নেপচুন" [নেপচুনের পরে এক গ্রহের অনুসন্ধান]। আইসিস। ৫৫ (২): ১৬৩–১৮৩। এসটুসিআইডি 144255699। জেস্টোর 228182। ডিওআই:10.1086/349825।