একদিকে দেশীয় রাজাদের অকর্মণ্যতা আর একদিকে ক্রমশ ঘনিয়ে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ছায়া, দুয়ের মাঝে বিস্তীর্ণ মধ্যভারত শাসন করে এক লুটেরা খুনির দল। এমনই এক লুটেরা দলের সর্দার ভুকোত জমাদারকে অকস্মাৎ সরিয়ে দিয়ে দলের কর্তৃত্ব হাতে নেয় এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্রাহ্মণ। না, লুটের ধনসম্পদ নয়, অলৌকিক শক্তির অধিকারী সেই ব্রাহ্মণ প্রতিটি শিকারের পর চেয়ে নেন শুধুমাত্র একটিই জিনিস, শিকারের মৃতদেহ! কে এই ব্রাহ্মণ? কী করেন ইনি মৃতদেহ দিয়ে?
মায়ারানি হালদারের বংশে হাজার বছর ধরে পূজিত হয়ে এসেছে একটি অভিশপ্ত পাথুরে ফলক। কিন্তু কেন? হাজার বছর আগে কী ঘটেছিল সোমপুরা মহাবিহারের গর্ভগৃহে? এক জটা দেবীর নামে কাকে অভিশাপ দিলেন মহাস্থবির রত্নাকরশান্তি? টেনিয়া কি পারবে বালুরঘাটের তিনটি মেয়েকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে এনে দালালদের কাছে বিক্রি করে দিতে? মেখলা-কনখলার কাহিনিটাই বা কী? কী হবে অসহায় মেয়ে তিনটির?
অতীনকে যেন তার সমস্ত অস্তিত্বসহ অজগরের মতোই গ্রাস করে নিল মূর্তিটা। রোজ ভোগ বেড়ে দিত সে, এই আশায় যে মা খাবেন, গ্রহণ করবেন ভোগের প্রসাদ। কিন্তু মা সেদিনই ভোগ নিলেন যেদিন ডামরি এসে উপস্থিত হলো এ বাড়িতে। কে এই ডামরি? মূর্তিটাই বা কোন দেবীর? বৌদ্ধতান্ত্রিক সহস্রাক্ষ কেন বানিয়েছিলেন এই মূর্তি? অতীনের পিতৃবন্ধু ভবেশবাবু কি পারবেন অতীনকে বাঁচাতে?
আফগান সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে একদল শিশুকে বাঁচাবার দিনেই পর্তুগালের কম্যান্ডোবাহিনীর নায়ক মার্টিনেজ তাজ খবর পেলেন তাঁর একমাত্র ছেলে তিয়াগো মৃত্যুশয্যায়। বাড়ি এসে এক আশ্চর্য ইতিহাসের সম্মুখীন হন মার্টিনেজ, শোনেন গোয়াতে পর্তুগালের আধিপত্য বিস্তারের সময় তাঁরই এক পূর্বপুরুষের ইনক্যুইজিশনের নামের কৃত একটি মহাপাপের ইতিবৃত্ত। শোনেন তজ্জনিত এক ভয়াল অভিশাপের কথা, যার জন্যে আজ তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় মাতৃহারা সন্তানটি মৃত্যুশয্যায়। কী হলো তারপর? আমোনা গ্রামের বেতালমন্দিরের সামনে কীভাবে মিলে গেল পাঁচশো বছরের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া কাহিনির সূত্র?
কীভাবে বাংলার অক্সফোর্ড নবদ্বীপের এক বিস্মৃতপ্রায় মহাপণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ হয়ে উঠলেন বিভিন্ন কালখণ্ডে ধৃত এই সমগ্র কাহিনিমঞ্জরীটির একমাত্র তন্ত্রধারক? আসুন পাঠক, প্রবেশ করি সেই গহিন অরণ্যে, শুধু মনে রাখবেন একটি মাত্র মন্ত্র, ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় যাদু।
শান্তো বিনীতঃ শুদ্ধাত্মা শ্রদ্ধাবান্ ধারণক্ষমঃ। সমর্থশ্চ কুলীনশ্চ প্রাজ্ঞঃ সচ্চরিতো যতিঃ। এবমাদিগুণৈর্যুক্তঃ শিষ্যো ভবতি নান্যতা।। (তন্ত্রসার) অর্থাৎ: শমাদিগুণযুক্ত, বিনয়ী বিশুদ্ধভাব, শ্রদ্ধাবান্, ধৈর্য্যশীল, সর্বকর্ম-সমর্থ, সদ্বংশজাত, অভিজ্ঞ, সচ্চরিত্র এবং যতি-আচারযুক্ত ব্যক্তি প্রকৃত শিষ্য-শব্দবাচ্য, ইহার বিপরীত ব্যক্তিকে শিষ্য করিবে না। (অনুবাদ রণদীপম বসু-র সৌজন্যে প্রাপ্ত) আমি কি কোনোভাবে উপরোক্ত শর্তাবলি পূরণ করি? মনে তো হয় না। তাই, বিদ্যা ও ক্রোধ, ভয় ও কষ্ট, শক্তি ও অসহায়তা, সর্বোপরি ইতিহাস ও বর্তমানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে কীভাবে পাঠককে শিহরিত, স্তম্ভিত, মুগ্ধ, এমনকি সজলনয়ন করে দেওয়া যায়, এই গুপ্তজ্ঞান আমার বোধহয় এযাত্রা শ্রী অভীক সরকারের চরণে আশ্রয় নিয়ে আর শেখা হল না। নইলে, মা কসম! আমি কালকেই ভদ্রলোকের কাছে হাজিরা দিতাম, এবং অত্যন্ত ভদ্র ও শান্তভাবে বলতাম, “আমাকে একটু শিখিয়ে দাও বস্, কীভাবে তুমি এই জিনিস লিখতে পারলে?” ভাবছেন আমি ইয়ার্কি মারছি? ঠিক ধরেছেন। হাসি-ঠাট্টার ছলে আমি আসলে বেরিয়ে আসতে চাইছি সেই মুহূর্তগুলোর নাগপাশ থেকে, আগুন ও অন্ধকার দিয়ে গড়া সেই ভয়ের নিগঢ় থেকে, যাতে আমাকে এতক্ষণ বেঁধে রেখেছিলেন লেখক। “এবং ইনকুইজিশন”, হে ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেই আবির্ভাব, যাকে পাশ্চাত্য ধারণায় আমরা প্যারাডাইম শিফটের ইঙ্গিতবাহী তথা সূচনাকর্তা হিসেবে চিহ্নি��� করতে পারি। বাংলায় ভয়ের গল্প লেখা হয়েছে বিস্তর। এমনকি তন্ত্র বা তার অভিচার নিয়েও এর আগে লেখা হয়েছে ‘তারানাথ তান্ত্রিক’-এর কয়েকটি অবিস্মরণীয় কাহিনি। কিন্তু তন্ত্র-নির্ভর ভয়ের গল্পের পরতে-পরতে ইতিহাস আর একান্ত বাস্তব মানুষী অন্ধকারের অঙ্গার মিশিয়ে দিতে আর কেউ পেরেছেন কি? অন্তত এপার বাংলায় এই বই একমেবাদ্বিতীয়ম, এবং আগামী দিনে তন্ত্র ও আতংক নিয়ে বাংলায় যাই লেখা হোক না কেন, তার বিচার হবে এই বইটির মাপকাঠিতেই। কী আছে এই বইতে? আছে তিনটি গল্প, এবং একটি বড়োগল্প, যাকে এই বাংলার পরিভাষায় আমরা উপন্যাসই বলতে পারি। গল্প নামক মৎস্য ও মাংসের কথায় আসার আগে অতি স্বল্পমাত্রায় হলেও তিক্তরসের আস্বাদন করতে হচ্ছে অবশ্য। বইয়ের শান্তনু মিত্র-কৃত প্রচ্ছদটি গথিক ভয়ের আবহ ফোটাতে সক্ষম হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অন্ধকারের আতিশয্যে প্রচ্ছদের সূক্ষ্ম বিবরণ ঢাকা পড়ে গেছে। হয়তো প্রচ্ছদটি নিয়ে একটু ভিন্নতর ভাবনার প্রয়োজন ছিল। বইটিতে মুদ্রণ প্রমাদ নেই বললেই চলে। একবার পৃষ্ঠান্তরে একই লাইন দু’বার ছাপতে গিয়ে ‘ভারি’ (যা এক্ষেত্রে very-র সমার্থক বলে সঠিক বানান) হয়ে গেছে ‘ভারী’ (যা হয় শুধুমাত্র heavy বোঝাতে)। এটুকু ছাড়া আর তেমন কিছু আমি দেখিনি। এবার গল্পরা। এই বইয়ের প্রথম গল্প ‘শোধ’। ঋতবাক-এ প্রকাশিত এই গল্পটি অনেকেই পড়েছেন। বাস্তব ইতিহাস, ঠগিদের কীর্তিকলাপ, মানবিক অসহায়তা, আর তন্ত্রের বীভৎসতা, এসবের উদাহরণ কতটা ভয়াল, কতটা উপাদেয়, এবং কতটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তা বোঝার জন্য এই গল্পটি যথেষ্ট। এতে ভয় আছে, আছে কিছু বর্ণনায় ঘাড়ের কাছের ছোটো-ছোটো চুলগুলোকেও প্রায় দণ্ডায়মান করে দেওয়া অনুভূতির জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা। কিন্তু এই গল্পটি অতি-অতি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে তার ইতিহাসে, ঠগিদের কাজের নিপুণ বর্ণনায়, এবং কন্যার মৃত্যুতে পাগলপারা এক মানুষের হাহাকারে। দ্বিতীয় গল্প ‘রক্তফলক’। বিশুদ্ধ ভয়ের গল্প হিসেবে এটির মতো কাহিনি আমি কমই পড়েছি। শুধু অতিলৌকিক পরিবেশ ও দেবদেবীদের বর্ণনা নয়, এই গল্পের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হল এতে ফুটিয়ে তোলা মানুষী শয়তানি। এই চরম ‘অশুভ’-র বাস্তবতা ও সম্ভাবনা আমার-আপনার মতো প্রতিটি কন্যাসন্তানের পিতা-মাতাকে আরও বেশি করে তাড়িত করবে, বাক্রুদ্ধ করবে, নিজের অজান্তেই আমাদের হাতদু’টো এক করে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা পুলিশের কাছে প্রার্থনা জানাবে, যাতে আমাদের কন্যারা নিরাপদে থাকে। তৃতীয় গল্প ‘ভোগ’। এই গল্পটিও আগে ঋতবাক-এ প্রকাশিত হয়েছিল। তন্ত্র-নির্ভর ভয়ের গল্পের ক্ষেত্রে এটিই শেষ কথা হয়ে থাকবে। যদি এখনও এই গল্প না পড়ে থাকেন, তাহলে শুধু এটুকুই লিখি যে অনাহূতভাবে এক মানুষের ঘরে এসে পড়ে এক দেবীমূর্তি, আর তার পূজা নিয়ে তারপর ... গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! তাই আর কিছু লিখছি না। বাকিটা পড়ুন, আর তারপর দিনের বেলাতেও শুকনো গলায় বাইরেটা দেখে বোঝার চেষ্টা করুন যে হঠাৎ হওয়া অন্ধকারটা আকাশে মেঘ জমার ফলে হয়েছে, নাকি মিহি বরফের মতো আপনার বাড়ির ওপরেও নেমে আসছে গুঁড়ো-গুঁড়ো কোনো অপ্রাকৃত অন্ধকার! চতুর্থ লেখা, তথা প্রায়-উপন্যাস ‘ইনকুইজিশন’। এই কাহিনির সূত্রপাত প্রায় পাঁচশো বছর আগে, যখন পোপের ইচ্ছাপূরণ করার জন্য এক পর্তুগিজ অভিজাত সসৈন্য হামলা চালিয়ে, মহাবেতাল মন্দিরের গোপন গর্ভে রাখা এক আশ্চর্য জিনিস কেড়ে নিয়েছিলেন সেই মন্দিরের পুরোহিতের কাছ থেকে। শুধু সেই অপার্থিব বস্তুটি লুণ্ঠনই নয়, মন্দিরের পুরোহিত ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী ও তাঁর পরিবারকে, এমনকি পুরোহিতকে সেই জিনিসটি নিয়ে পালাতে সাহায্য করা মানুষদেরও বর্ণনাতীত অত্যাচার করে হত্যা করা হয়েছিল। নিঃসীম প্রতিশোধস্পৃহা সেই পুরোহিতের মুখ দিয়ে এমন এক অভিশাপ উচ্চারণ করায় যার প্রকোপে পর্তুগিজ অভিজাতটির পরিবারের ওপর নেমে আসে বেতালের করাল দংষ্ট্রা। হাল ছেড়ে দেয়নি সেই পরিবার। অনুতাপের আগুনে দগ্ধ মানুষের প্রায়শ্চিত্ত, আর সন্তানের মঙ্গলকামনা মিশে গেছে তাদের আকুলতায়। অবশেষে তারা জানতে পেরেছে কীভাবে এই অভিশাপ কাটবে। তারপর কী হয়? এই বইয়ের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রচনা এটি। বইটির যা-কিছু দুর্বলতা তাও ধরা পড়েছে এতে। পর্তুগিজদের নৃশংসতা বোঝাতে গিয়ে অতিকথন, নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভে অতিরিক্ত ও আরোপিত ব্যাকস্টোরি, অত্যন্ত ভয়োৎপাদক কিন্তু কাহিনির নিরিখে অপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু বর্ণনা ও আনুষঙ্গিক কথন, অকাল্টের ইতিহাস, কম্যান্ডো অ্যাকশনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ... এমন বেশ কিছু জিনিস রয়েছে এই কাহিনিতে যা বিষয়ের প্রতি লেখকের ভালোবাসা যতটা ফুটিয়েছে, ততটাই হয়তো কাহিনির গতি কেড়েছে। তবে এই বইয়ের ওস্তাদের মার এসেছে ‘ইনকুইজিশন’-এর একেবারে শেষে, যেখানে পিতৃস্নেহ নয়, জগজ্জননীর কল্যাণস্পর্শই রুদ্ধ করেছে নরকের দ্বার। সেই মুহূর্তটায়, হে পাঠক, আপনি যেমনই হোন না কেন, আপনার অন্তরাত্মা একবারের জন্য হলেও চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা কল্পনা করবে। কালভৈরব ও বেতালের প্রবল দাপট নয়, আপনার মনের রুক্ষ জমিতে ছাপ ফেলে যাবে রক্তলাল দু’টি চরণ। এই বইয়ের চারটি কাহিনিতেই নানা রূপে, নানা ক্ষমতায় এসেছেন যুগাবতার, কালচক্রের বাইরে থাকা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তবে এই বইয়ের গল্পরা যতটা তাঁর, ততটাই ইতিহাসের, মানুষের, দীর্ঘশ্বাসের, আতংকের, এবং আলোর। দয়া করে বইটি পড়ুন। নিজের ইতিহাসকে জানুন। জানুন আমাদের রোজকার ধর্মাধর্ম ও সংস্কারের পেছনে লুকিয়ে থাকা গূঢ় সত্যকে। ভালোবাসুন আমাদের এই জীবনকেই। সাক্ষী হোন বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তরের।
তারানাথ তান্ত্রিকের সাথে পরিচয় আমার সেই কৈশোর বয়সে,ভয়ে কাটা হয়ে যেতাম কিন্তু তাও পড়ার লোভ সামলানো বড় দুষ্কর হয়ে পড়তো,এখন অব্দি ও সেই কৈশোরের টান একবি���্দুও মলিন না হয়ে বরং সময়ের সাথে প্রগাঢ় হয়েছে এই বন্ধন। সে বন্ধনের জোরে না আমার অনুসন্ধিৎসু মনের জন্য এ বছরের শুরুতেই হাতে পেলাম "সেই অজানার খোঁজে"অবধূত কালীকিংকর মশাই আমাকে তারানাথের মতই তার গল্পে বুঁদ করে রেখেছিলেন.
তন্ত্র মন্ত্র শব্দটা শুনলেই মনে হয় সবকিছু হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত, এবং বললে বোধহয় ভুল হবে না আমাদের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ধারনাই এটা তান্ত্রিক তন্ত্রসাধনা এগুলো সব সেই অনাদিকাল থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই চর্চা হয় শুধু,তাই এসব নিয়ে বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি করে কেউ বিপাকে পড়তে চায়না এই ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে.
কিন্তু তন্ত্রের এই মন্ত্রের উৎপত্তি যে বৌদ্ধধর্ম থেকে তা আমার অজানাই থাকতো যদি অভীক সরকারের এই বইখানা পড়া না হত. প্রতিটি গল্পই এত সুন্দর এবং ইউনিক যে আমি বাধ্য হয়েছি অন্য সব বই বাদ দিয়ে এতেই মগ্ন হয়ে থাকতে. তবে আমার নিজের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে "ভোগ" গল্পটি, রাতের বেলা পড়ার সময় ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম দিনের বেলায় ও মাঝেমধ্যে যে গায়ে কাঁটা দেয়নি তা বললে নির্জলা মিথ্যাচার হবে আর কি 😐
এবং শেষ গল্পটি কথায় বলে না ওস্তাদের মার শেষ রাতে এই কাহিনীটি ঠিক তেমন, অতীত আর বর্তমানের মেলবন্ধন বাকিগুলোতে থাকলেও ১৫০০ শতকের সেই সময়ের সাথে বর্তমানের সম্পর্ক যে বিনিসুতোয় বাধা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে তারিফযোগ্য
তবে পুরো বইয়ে একটি চরিত্র পাবেন সব জায়গায় এবং তার সেই একটি আপ্তবাক্য"ভালোবাসা থেকে বড় ম্যাজিক আর নেই"একথা শুনে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রতি আপনার মুগ্ধতা কাজ করবে না এই কথা বলা বড় শক্ত
একটি চোখবুঁজে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে দেওয়া পাঁচ তারা বইটি আপনাকে অতীত বর্তমানের রোলার কোস্টার অভিযানের সাথে হাসি কান্না ভয় সহ আরো নানা অনুভূতি দিবে অনায়াসে,সময় থাকলে পড়ে ফেলুন
রেটিং :🌠🌠🌠🌠🌠 এর বেশি দেওয়ার সুযোগ থাকলে একটু ও কিপটেমি করতাম না 😍
আমি একটা বই পড়ার উদ্দেশ্যে হিসেবে দেখি চিন্তার রসদ। সাধারণত ভৌতিক কিংবা থ্রিলার গল্পে চিন্তার রসদ কমই পাই আমি। থাকে শুধু এন্টারটেইনমেন্ট। এসব দিক থেকে বললে এবং ইনকুইজেশন একটা ব্যতিক্রমী বই। বইটা গল্পের। কয়েকটা ভৌতিক অথবা বলা চলে তান্ত্রিক প্লট নিয়ে গল্পগুলা লিখিত। চারটা গল্প আছে বইটিতে। শোধ রক্তফলক ভোগ এবং ইনকুইজেশন সবগুলো গল্পই বেশ ভাল। মুলত যাদুবিদ্যা আর অভিশাপ নিয়ে, কিন্তু ভারতীয় দর্শন আর তান্ত্রিকতা নিয়ে গঠন করা হয়েছে গল্পগুলো। বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণ যে ধারা তুলে দিয়ে গিয়েছেন সেটা পরবর্তী লেখকরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ভাল করেই। আমি শুরুতেই চিন্তার রসদের কথা বলেছিলাম। এই রসদ হল তন্ত্র নিয়ে৷ আগে তন্ত্র সম্পর্কে ভুল ধারনা ছিল আমার৷ সেই সাথে বুদ্ধ ধর্ম নিয়েও। তন্ত্রে বুদ্ধ ধর্মের এত বেশী influence আছে আগে জানতাম নাহ। আর বলতে গেলে তন্ত্রসাধনা বুদ্ধ ধর্মের মহাজান শাখা এবং সেখান থেকে তিব্বতের বজ্রযান হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করছে। এসব তথ্য আমাকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। আর একটা দিক না বললেই নয়, লেখকের গল্পের গন্ডি শুধু ভারত, হিন্দু/বুদ্ধ ধর্মই নয় বরং ইউরোপ আর খ্রিস্টান ধর্মকেও ছুয়ে গিয়েছে। এবার মনে হচ্ছে বুদ্ধ ধর্ম নিয়ে পড়ার সময় চলে এসেছে।
ভালোই লেগেছে। বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মমতের তন্ত্র সাধনা নিয়ে লেখা মোট ৪ টা গল্প আছে। শেষ গল্পে আবার ক্রিশ্চিয়ান মতের তন্ত্রসাধনার ব্যাপারে উল্লেখ আছে। বেশ পড়াশোনা করে খেটে গল্পগুলো বানানো হয়েছে, শেষে আবার তথ্যসূত্র দেয়া রয়েছে, সেটা বেশ ভাল ব্যাপার যার কারনে নতুন তথ্য জানা যায়৷ প্রতি গল্পের একজন কমন ত্রানকর্তা রয়েছেন, এভাবে আরো লিখে গেলে সিরিজ হিসেবে দাড় করানো সম্ভব। আহামরি আনকমন গল্পের প্লট নয় তবুও পড়তে খারাপ লাগেনা। আসল রেটিং সাড়ে তিন তারা। কেউ জিগেশ করলে বলব পড়তে পারো/পারেন।
তন্তসাধণা নিয়ে ফিকশনে যেকোনো বিচারেই এই বই একটা মাইলফলক। এরসাথে ভাষা, কাহিনি, বর্ণনা, ঠগী, কমান্ডো অপারেশন, তন্ত্রের ইতিহাস আর দুর্ধর্ষ সব ইলাস্ট্রেশন মিলে একদম বাঁধিয়ে রাখার মত পড়ার অভিজ্ঞতা। পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক ঠগীর শবসাধনা, বৌদ্ধ বজ্রযানের দেবী বজ্রবারাহী, ছিন্নমস্তা, তিব্বতি দেবী মাতঙ্গী, পিশাচী ডামরী আর ভয়ানক মহাবেতালের ���ই মানের দুর্ধর্ষ কাহিনি আর গ্রাফিক বর্ণনা বাংলা সুপারন্যাচারাল ফিকশনে আর নেই বললেই চলে।
অভীক সরকারের লেখা এই প্রথম পড়লাম। অনেক পড়াশোনা করেই তিনি গল্পগুলো লিখেছেন। গল্পের পটভূমি বিচিত্র ও বিস্তৃত। কল্পনার চরিত্রগুলোর সাথে অভীক সরকার মিলিয়ে দিয়েছেন বাস্তবের মানুষদেরও। কখনো ঠগী উৎখাতকারী হেনরী স্লিম্যান, কখনো সোমপুর বিহারের প্রাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এসেছেন গল্পের চরিত্র হয়ে। গল্পের পটভূমি কখনো মধ্যভারত, কখনো পর্তুগাল, কখনো গোয়া, কখনো আফগানিস্তান, মুম্বাই অথবা শহর কলকাতা সময়কাল কখনো পাল আমল, কখনো মধ্যযুগ, কখনো উনিশ আবার কখনো বর্তমান একবিংশ শতাব্দী। তবে একটি চরিত্র ফিরে ফিরে এসেছেন প্রতিটি গল্পে, ইনিও এক ঐতিহাসিক চরিত্র, নবদ্বীপের বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। সপ্তদশ শতকের এই সাধককে অভীক সরকার ফিরিয়ে এনেছেন তার গল্পে। গল্পের মূল নায়ক তিনি হয়তো নন, তবে গল্পের নিয়ন্তা তিনিই। স্বল্প উপস্থিতি দিয়ে তিনিই কাহিনীর গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
অভীক সরকার তন্ত্র শক্তির ভয়াল দিক যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি এর শুভ শক্তির দিকটির জয়ও দেখিয়েছেন। তিব্বত আর ভারতে চর্চিত তন্ত্রের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন ইউরোপে প্রচলিত ব্ল্যাক ম্যাজিককেও। শুভ শক্তির দেব দেবীকে যেমন দেখিয়েছেন তেমনি এনেছেন স্বাক্ষাৎ শয়তানকেও। হিন্দু, বৌদ্ধ তন্ত্র আর এই দুই ধর্মের দেব দেবীদের যোগসূত্রও কিঞ্চিৎ ধরিয়ে দিয়েছেন। তবু দু’একটি সাধারণ দূর্বলতা না বলে পারছিনা। পর্তুগীজ বালক তিয়াগো তার দাদুর কাছে ইংরেজী ভাষায় হি হ্যাজ কাম বলবে কেন। মিগুয়েল এর ডায়েরীর সব কথা সাধু ভাষায় লেখার কোন দরকার ছিল কি? এরকম সামান্য কিছু ত্রুটির বাইরে সবমিলিয়ে ভালো লেগেছে। যদিও ভয় সৃষ্টি বা শুভ অশুভের লড়াই পড়ার চেয়ে আরও স্নিগ্ধ সুন্দর কিছু পড়তে বেশি ভালো লাগে আমার, তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পে যেমন ভয়ের সাথে সাথে একটা মায়া জড়ানো থাকে অভীক সরকারের গল্পে সেটা মিসিং। আগামীতে লেখক তেমন গল্পও হয়তো লিখবেন, এটাই প্রত্যাশা।
"সবসময় মনে রাখবেন, ভালোবাসাই হলো সবচেয়ে বড় তন্���্র, সবচেয়ে বড় যাদু..." ______________________ এই একটা লাইনই বোধহয় যথেষ্ট এই বইটাকে পছন্দ করার জন্য। অসংখ্য পজিটিভ রিভিউ দেখে দেখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কবে এই বইটা পড়ার সুযোগ পাবো। যখন সুযোগ পেলাম আর দেরী করিনি পড়া শুরু করতে। কিন্তু দ্বিতীয় গল্পে গিয়ে থেমে যেতে হয় নানা ঝামেলার কারণে। এর মধ্যে আরও অনেক হালকা ধাঁচের বই পড়ে শেষ করেছি। কিন্তু এটা আর ধরা হচ্ছিলো না। একটাই কারণে, এই বইটাকে আমি শান্ত, ধীরস্থিরভাবে, সময় নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। সেই সময়টা করে ওঠা যাচ্ছিলো না। তবে যাইহোক, এইবার সেই সময়টা মিলে গেলো। কাল থেকে একটানা পড়ে আজ শেষ করলাম। এবং আমি অভিভূত...
বইটা পড়ে আক্ষরিক অর্থেই আমার বেশ অপার্থিব আর অলৌকিক একটা অনুভূতি হয়েছে। হয়ত এতে পরিবেশেরও বেশ একটা প্রভাব ছিলো। শীতকালের দিনগুলো এমনিতেই কেমন যেন বিষণ্ণ আর ছায়াময় লাগে আমার কাছে। এমন রৌদ্রহীন, ছায়াছায়া শীতের ভরদুপুরে এরকম তন্ত্রমন্ত্রের বই মনের মাঝে সূক্ষ্ম একটা ভয়ের আবরণ বোধহয় এমনিই বিছিয়ে দেয়। আর লেখক যদি শব্দের কারসাজিতে বইয়ের বর্��নাশৈলীতে ভয়ের আবহ চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলেন তবে তো কথাই নেই।
দ্বিতীয় গল্পটার শেষাংশ বাদ দিলে, প্রতিটা গল্পই চমৎকার। দ্বিতীয় গল্পের শেষটা আমার ঠিক মনঃপূত হয়নি। কিছুটা অসম্পূর্ণ লেগেছে। এটার জন্য প্রথমে ভেবেছিলাম রেটিং চারের বেশী দেয়া যাবে না। কিন্তু শেষ গল্পটা আমাকে এতবেশী নাড়া দিয়েছে যে, মনে হলো শুধু এই গল্পটার জন্যই ৫ দেয়া যায়। আর লেখনীর ব্যাপারে তো আগেই বলেছি। এক কথায় চমৎকারভাবে প্রতিটা গল্পকে লেখক সাজিয়েছেন।
আমার মত সাধারণ পাঠক হলে আর তন্ত্রমন্ত্রের রহস্যময় জগতে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যেতে যাইলে এই বইটা আপনি পড়তে পারেন। আর যদি আপনার তারানাথ তান্ত্রিক পড়া থাকে তবে এই বইয়ের স্বাদ আরও বেশী করে অনুভব করবেন, এটুকু বলতে পারি।
পর্তুগালের বিখ্যাত ভাজ পরিবারের উপর রয়েছে প্রায় পাঁচ শ'ত বছরের পুরোনো একটা অভিশাপ। স্বয়ং বেতালের দেয়া অভিশাপে ওই অভিজাত পরিবারটির জৈষ্ঠ্য সন্তান খুব বেশি দিন বাঁচে না। মোটামুটি একটা পরিত্রাণের উপায় পেয়ে মৃত্যুশয্যায় একমাত্র পুত্র থিয়াগোকে রেখে অভিশাপ থেকে মুক্তির আশায় রহস্যময় এক তান্ত্রিক পুরুষ কৃষ্ণানন্দ আমবাগীশ আর ইউরোপের ইস্পাত নামে খ্যাত কর্ণেল ভাজ গোয়ার আমোনা গ্রামে রুদ্র বেতাল মন্দিরের সামনে শুরু করে সাধনা। সে কি আর যে সে সাধনা! বেতালকে আহ্বান করা কি মুখের কথা? বেতাল! সাক্ষাৎ যমদূত। সে এলে আহ্বানকারীর প্রাণ সংহার না করে তুষ্ট হয় না। তাই সাধনার পূর্বে আহ্বান করা হয়েছে দেবী কালভৈরবীকে। দেবীকে তুষ্ট করে তবেই আহ্বান জানানো হবে বেতালকে। শুরু হলো আহ্বানক্রিয়া। চারপাশে ঘোরাফেরা করছে অতৃপ্ত আত্মারা, পৃথিবী যেন আর সেই চিরচেনা পৃথিবী নয়। পাতালের নরক থেকে উঠে আসা প্রেতরা চেষ্টা করছে মায়ায় ফেলে পূজা ধ্বংস করে দিতে.. এ হেন টানটান উত্তেজনার মুহূর্তে আমি মর্কট (ভয়ের চোটেই কি না কে জানে) কঠিন ঘুমে 🐸 পরদিন ঝাঁ চকচকে আলোর উপস্থিতিতে পড়লাম বেতাল পর্ব। কী হলো? ভাজ পরিবার কি সেই অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে পারলো? পৃথিবীজোড়া বিখ্যাত 'ইউরোপের ইস্পাত' নামে খ্যাত মার্টিনেজ ভাজ কি পুত্রের জন্য বেতালের কাছে আহুতি দিলেন?
কোথায় ভারতবর্ষ আর কোথায় পর্তুগাল। রুদ্র বেতাল কেনই বা এতো ক্ষেপা হয়ে গেলেন যে দেশ-কাল-পাত্র ভেদে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ একটা পরিবারকে অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে সেটা জানার জন্য পড়তে হবে অভীক সরকারের 'এবং ইনকুইজিশন' বইটি।
ইদানিং তন্ত্র-মন্ত্র, ইতিহাস, মিথ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর বই লেখা হচ্ছে। একটা জিনিস যেটা সবচেয়ে বিরক্তিকর, সেটা হলো এ ধরণের বইগুলোর প্রায় প্রত্যেকটাতেই একটা 'অতি পন্ডিত' ক্যারেক্টার থাকে। ইনারা আবার মহাজ্ঞানী প্রজাতির। জগতের হেন বিষয় নেই যা ইনারা জানেন না। শুধু নিজ বিষয় না, অন্য সব বিষয়ে সমান জ্ঞান রাখেন এবং প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে গড় গড় করে উইক্কির মতো সন তারিখ মুখস্ত বলে রহস্য উদ্ধার করে কেসের সানডে মানডে ক্লোজ করে দেন। অভীক সরকারের বইটা তন্ত্র-মন্ত্র নিয়ে লেখা হলেও ওই দোষ হতে যথেষ্ট পরিমাণে মুক্ত। যতোটুকু না জানাইলে না, কিংবা যার মুখে ঠিক যতোটুকু মানায় ততটুকুই চরিত্রগুলোর ইতিহাসের ফড়ফড়ানি দিয়েছেন। এবং এই পরিমিতিবোধটাই সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে।
টোটাল চারটা গল্প আছে বইয়ে। ভোগ গল্পটা পড়েছিলাম আগেই। এবং তখন যেমন উপভোগ করেছিলাম, গতরাতে তৃতীয় বারের মতো পড়তে যেয়ে সেই সমান ভয় পাওয়া, সেই একই রকম গ���য়ে কাঁটা দেওয়া-মোটমাট প্রচন্ড ভয়ের হলেও আমার পড়া পছন্দের গল্পগুলোর মাঝে একদম প্রথম দিকেই থাকবে ভোগ। বইয়ের ভোগের চেয়ে আরও বেশি গায়ে কাঁটা দেয় সানডে সাসপেন্সের ভোগে। ভাই গো ভাই! কদ্দিন যে থেকে থেকে চমকে উঠেছি ডামরির কণ্ঠ মনে করে! :/
প্রথম গল্প শোধ মোটামুটি রকমের। শুরুটা দুর্দান্ত ভাবে হলেও ইন্ডিংটা নিয়ে আরেকটু কাজ করা যেতো কিছুটা অতৃপ্তি রয়ে গেছে। (অন্তত আমার কাছে) বইয়ের দ্বিতীয় গল্প 'রক্তফলক'। এটা নিয়েও সেইম কম্পলেইন। কিন্তু ওটাও বেশ উপভোগ্য।
রেটিঙের হিসাবে আসলে এবং ইনকুইজিশন আর ভোগের জন্য বইটা পুরোপুরি পাঁচ তারকা তো বটেই তার চেয়ে বেশি তারকা আশা করে। বহুদিন বাদে তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে বেশ উপভোগ্য একটা বই পড়লাম। আর শোধ আর রক্তফলকের জন্য তারকা কিছুটা কম। 🐸 যাই হোক, আমি অভাজন পাঠক। প্রচন্ড ভয়ের সাথে বিমলানন্দ পেয়েছি, এই বা কম কি। লেখকের শুভ হোক।
এই বই নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই প্রশংসা করতে হয় লেখকের দু'টি গুণের--মাত্রাজ্ঞান এবং ফিনিশিং। লেখক একজন উঁচুদরের গল্পবলিয়ে, কিন্তু গল্প বলতে বলতে তিনি সীমানা ছাড়িয়ে দিগবিদিক চলে যান না, এবং জানেন কখন, কোথায় ও কিভাবে থামতে হয়। গত এক বছরে দুই বাংলার নতুন লেখকদের গোটা তিরিশেক মিস্ট্রি-হরর-থ্রিলার-ফ্যান্টাসি ঘরানার বই পড়েছি; এদের অনেকেই ভাল স্টোরিটেলার এবং লেখার বিষয় নিয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছেন বোঝা গেলেও প্রায় কারো মাঝেই মাত্রাজ্ঞান ছিল না। জ্ঞান দিচ্ছেন তো দিচ্ছেনই (পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের মাঝে এই প্রবণতা বেশি), থামাথামির নাম নেই, কাজেই রহস্য বা থ্রিলার উপন্যাস হয়ে গেল সাধারণ জ্ঞানের বই। অথবা গল্প বলতে বলতে সুতো এত জায়গায় ছড়িয়ে গেছে যে, পরে নিজেই আর সেই সুতো কোনটা কোথায় গেছে খুঁজে পান না (এই প্রবণতা বাংলাদেশের লেখকদের মাঝে বেশি)। এবং উভয়ক্ষেত্রেই ফিনিশিং মোটামুটি জঘন্য রকমের খাপছাড়া ও তাড়াহুড়ো করে দেয়া। অভীক সরকার এখানে ১০০ ভাগ সফল। ৪টা গল্পই ঠিক যতটা দরকার ততটাই টেনেছেন, এবং ফিনিশিংগুলো খাপছাড়া লাগেনি।
এবার গল্প নিয়ে বলি। বেশিরভাগের দেখলাম ৩য় গল্প, 'ভোগ', বেশি ভাল লেগেছে। আমার কাছে এটা মোটামুটি গতানুগতিক গল্প লেগেছে, হয়তো বেশ কয়েক বছর আগে কাছাকাছি এক প্লট নিয়ে লেখা মুহাম্মদ আলমগীর তৈমুরের একটা গল্প (নামটা মনে করতে পারছি না, একজন একটা দোকান থেকে ব্যাবিলনের লিলিথের এক মূর্তি নিয়ে আসে, এরপর সেই দেবী বা অপদেবীর প্ররোচনায় একের পর এক অকাজ করতে থাকে, এরকম প্লট) পড়েছিলাম বলেই অতটা নতুন কিছু লাগেনি। ২য় গল্প, 'রক্তফলক', মনে হয়েছে সঙ্কলনের সবচেয়ে দুর্বল গল্প, ফিনিশিংয়ের কারণেই, আর পুরো গল্পে খানিক তাড়াহুড়ো ছিল। ১ম গল্প, শোধ, বেশ ভাল। যদিও স্লিম্যানের আরেকটু ভূমিকা আশা করেছিলাম। তবে সেরা গল্প মনে হয়েছে শেষটা, 'ইনকুইজিশন'। অতীত এবং বর্তমান, ইতিহাস এবং বাস্তব, অলৌকিক এবং লৌকিক, সেই সাথে তিনটা টাইমলাইন মিলিয়ে ১০০ পৃষ্ঠার নিচে একটা গল্পকে কোন ফাঁকফোকড় ��া গোঁজামিল না রেখে গুছিয়ে ফেলা খুবই কঠিন, এবং সেটা লেখক করেছেন দারুণভাবে। এই একটা গল্পের জন্য আলাদাভাবে তাকে অভিনন্দন জানাতে হয়।
আর শেষমেশ, হরর ঘরানার হলেও, ভয় লাগেনি কেন যেন। বরং টান টান উত্তেজনাপূর্ণ মনে হয়েছে। আর শেষদিকে এক সাধকের মুখ দিয়ে বলানো একটা কথা খুব মনে লেগেছে--"কিসের ধর্মভেদ সাহেব? কে কার ভগবান? পাপের যখন কোন ধর্মাধর্ম নেই, পুণ্যের ধর্মভেদ থাকে কিভাবে?"
অসাধারণ বললেও কম বলা হবে। বাংলা হরর সাহিত্যে এই বই সম্পদতুল্য। হিন্দু এবং বৌদ্ধ তন্ত্র নিয়ে দেয়া তথ্যগুলো কতটা হৃদয়গ্রাহী করে বুঝিয়ে গেলেন লেখক। আর গল্পগুলোর প্রশংসা আলাদা করে করতেই হয়। যেমন প্রারম্ভ, তেমন চরিত্র অঙ্কন, তেমনিই গল্পের উপসংহার। গল্পের প্রত্যেকটা চরিত্র নিজেদের স্থানে অনন্য। লেখকের অন্যান্য লেখা পড়ার জন্য মুখিয়ে আছি।
এই বই নিয়ে মাঝখানে তুমুল হাইপ উঠছিলো। ভাবছিলাম না জানি কী না কী বই। দুঃখের বিষয় হইলো হরর হিসাবে একমাত্র 'ভোগ' ছাড়া অন্য কোন গল্পই সেই অর্থে টানেনি। তবে হ্যাঁ, মিথোলজি আর ঐতিহাসিক তত্ত্বের দিক থেকে গল্পগুলো কালোত্তীর্ণ। প্রতিটা গল্পে তন্ত্র মন্ত্র আর হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবী, তাদের বিস্তারিত ইতিহাস পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। এ কারনেই চার তারা দেওয়া।
শিরোনাম গল্পে লেখকের থ্রিলার লেখার মুন্সিয়ানা টের পেলাম। আশা করি অভীক সরকারের লেখা একটা থ্রিলার পড়ার সৌভাগ্য একদিন হবে।
তিন,চারের দোলাচালে থাকতে থাকতে শেষমেশ চার তারকা-ই দিয়ে দিলাম।তন্ত্র-মন্ত্র,তান্ত্রিক,ব্লাক ম্যাজিক সম্পর্কিত চারটি গল্পের-ই কোনো এক পর্যায়ে ভায়াবহ রকমের বীভৎসতার দেখা পাওয়া যায়।তবে প্রতিটা গল্পে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।যে অংশটুকু রাতে পড়েছি সে অংশের ভয়াবহতা বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছি।আর দিনে পড়ার সময় তেমন কিছুই অনুভূত হয়নি।তবে সবমিলিয়ে অভিজ্ঞতাটা মোটামুটি ভালোই বলা চলে।
অনেকদিনের আশা পূর্ণ হল,প্রচুর প্রশংসা শুনেছি বইটার নিয়ে, অনেকদিন থেকে পড়ার সাধ ছিল। তারানাথ তান্ত্রিক পড়ার পর তন্ত্র বিষয়ক এই বইটাই খুঁজে পেলাম। এই বিষয় টার প্রতি আমার একটা অদম্য আকর্ষণ আছে।তাই এরকম একটা লেখা উপহার জন্য লেখককে অনেক অনেক ধন্যবাদ। প্রচ্ছদটা কেনো জানি ভালো লাগেনি, যেন যুতসই হয়নি।
তিনটে গল্প ও একটি উপন্যাস নিয়ে এই সংকলনটি, নাম গুলো - ১) শোধ ২)রক্তফলক ৩)ভোগ ৪) ইনকুইজিশন
সব গল্পগুলোতে একটা চরিত্রকে বার বার দেখা গিয়েছে, যিনি প্রতিটা গল্পে আবির্ভূত হয়ে মুশকিল আসান করেছেন।তিনি হলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।ইনি একজন সত্যিকারের বাস্তব চরিত্র। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন সপ্তদশ শতকের এক উচ্চস্তরের তন্ত্রসাধক।তন্ত্রশাস্ত্রে সুপন্ডিত এই তন্ত্রসাধক "তন্ত্রসার" গ্রন্থটি রচনা করেন এবং সমগ্র দেশে এই গ্রন্থটি সমাদৃত হয়।তাঁর প্রকৃত নাম কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্য। তন্ত্র সাধনার আগম পদ্ধতিতে সিদ্ধি লাভ করে তিন�� 'আগমবাগীশ' উপাধি পান।
" ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় যাদু " - এই কথার উপর বার বার জোর দেওয়া হয়েছে এই চারটে গল্পে।এবার প্রতিটা গল্পের বিষয়বস্তু সম্পর্কে দু চার কথা বলি।
১) শোধ : বাংলার ঠগি ও শব সাধনার সংমিশ্রনে এর কাহিনী। নবাবের আদেশে এহমেদ খান এক লক্ষ টিপু শাহী মোহর নিয়ে কোম্পানির আফিসে পৌঁছে দেবার জন্য রওনা হয়।পথে ঠগিদের পাল্লায় পড়ে সবার প্রাণ যায়। অন্যদিকে, ঠগী দের নতুন সর্দার দুর্গাশংকর পণ্ডিত (অর্থাৎ মূল চরিত্র) লুঠের মালের এক পয়সাও ভাগ নেয় না, নেয় শুধু লাশ। কি করেন তিনি প্রতিবার একটা করে তাজা লাশ নিয়ে ?এর পেছনে আছে তাঁর এক গূঢ় উদ্দেশ্য। জানতে হলে অবশ্যই পড়ুন।
🔺গল্পের শেষে আছে ভয়াবহ এক দৃশ্য। যদিও প্রথম দিকটা ভয়ের কিছু নাই। পুরোটা ঘটনা জানার পর ভালোই লাগবে।
২)রক্তফলক : এটাও তন্ত্র নির্ভর গল্প। অতীত বর্তমানের হাত ধরে গল্প এগিয়ে চলে। গল্পটি আধারিত একটি অভিশপ্ত ফলক ও নিষ্ঠুর টেনিয়া হালদারের অপকর্মের বিষয় নিয়ে।এখানে বৌদ্ধদের তান্ত্রিক শাখা ও বজ্রযানের কিছু আচার পদ্ধতির উল্লেখ আছে। এখানে দশমমহাবিদ্যার এক দেবী ছিন্নমস্তা-র কথাও উঠে আসে।ইনকুইজিশন গল্পের মতোই এখানে হালদার বংশ শাপ পাবে যে, হালদার বংশে এক বিকৃত মনস্ক সন্তান জন্মাবে যার জন্য ওই পরিবার ছারখার হয়ে যাবে।
🔺গল্পটা একটা সামাজিক বার্তা তুলে ধরে।আমরা এখানে দেখতে পাবো যে একটা মেয়ে ফেসবুকে একটি ছেলেকে দেখে প্রেমে পড়ে যাবে, যার জন্য পরিবার বাড়িঘর ছাড়তেও রাজি হয়ে যায়। তাই লেখক আজকালকার জেনারেশনের মেয়েদের বার্তা দিয়েছেন এরকম কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ভাবা উচিত কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে একটা ভুল পদক্ষেপ - গল্পের এই ব্যাপারটি তুলে ধরায় আমার বেশ ভালো লাগলো।
৩) ভোগ : অতীন কিউরিও শপ থেকে একটা অ্যান্টিক দেবী মূর্তি নিয়ে আসে।এরপর দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তাঁর পুজো করতে লাগলো অতীন। আর সেই থেকেই একটু একটু করে বদলে যেতে লাগলো অতীনের জীবন। তার জীবনে নেমে আসে কালো অন্ধকার। কোন দেবীর মূর্তি এটি ? কি হতে পারে এর পরিণাম। এর শেষটা খুবই ভয়াবহ।
🔺গায়ের রোম খাড়া করে দেবার মতো গল্প। দুর্বল ব্যক্তিরা যদি রাতের বেলা পড়েন নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যাবে। মনে হচ্ছিল কোনো গল্প না,হরর মুভি দেখছি,খুবই নিখুঁত বর্ণনা। আমার তো অন্ধকার হলেই এখন ভয় করতে শুরু করছে।অনেক ভয়ে ভয়ে রাতে ঘুমাতে পেরেছি। এত ভয় কোনোদিনও কোনও গল্প পড়ে পাইনি।এই বইএর সবথেকে সেরা গল্প এটি।
৪) ইনকুইজিশন : এই গল্পের নামেই মূল বইটি। গল্পটা দুটি অংশে বিভক্ত, একটা ঘটনা ১৫৬০ সাল নাগাদ, আর একটি ২০১৬ সাল নাগাদ এর ঘটনা ।দুটো সময়ের ঘটনাকে পর পর দেখানো হয়েছে। প্রথম অংশে দেখতে পাবো, মিগুয়েল ভাজ একজন হিন্দু ব্রাহ্মনের দ্বারা শাপ গ্রস্থ ( শাপ দেওয়া হয় যে বংশের প্রতিটা প্রথম সন্তান চরম কষ্ট পেয়ে মারা যাবে) হন, শুধু তিনি নন তার পুরো পরিবারই শাপ গ্রস্থ হয়। এরপর ২০১৬এর অংশে দেখা যায়, মার্টিনেজ ভাজ (পর্তুগাল বাসিন্দা) এর পরিবারকে নিয়ে গল্প এগোয়। অতীতের শাপ তাদের কিছু ছাড়ে না। তার একমাত্র ছেলে অজানা অসুখে আক্রান্ত হয়। অবশেষে পারিবারিক একটি ডায়েরির মাধ্যমে ছেলেকে বাঁচাবার একটা উপায় তারা পায়, তবে তা কোনো মানুষিক উপায় নয়, তা হলো অলৌকিক ও আধিদৈবিক উপায়।এরপর ?শেষপর্যন্ত কি তার ছেলেকে শাপ থেকে মুক্ত করে বাঁচানো সম্ভব হয় ?
🔺 অতীত ঘটনার থেকে ২০১৬এর সময়কার গল্পটা আমার তবু ভালো লেগেছে। আর এই গল্পেই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের সবথেকে বেশি উপস্থিতি চোখে পড়ে। কিছু নাম, শব্দ একটু খটোমটো আছে।অতীতের অংশটা একটু ছোটো করে বললেও হত। মার্টিনেজকে যখন তার বাবা পারিবারিক ইতিহাস শোনাচ্ছিলেন তখন যেগুলো জানাবার,সেই কথা গুলো বললেই হত, অত বেশি গাল- গল্পের দরকার কি ছিল !?
ভালো লেগেছে। কলকাতায় হরর গল্পে সয়লাব চারিদিক। আমি তো যেদিক তাকাই, সেদিকেই দেখি শুধু অসহ্য ভয় আর সাসপেন্স এর ভেলকিবাজি। এবং ইনকুইজিশন এ আগ্রহ পেয়েছি আমি যখন প্রথম ভোগ গল্পটা শুনি তার পরপরই। কলকাতার হররে আমার একটাই অভিয��গ, তারা কেউই তন্ত্র মন্ত্র থেকে বের হতেই পারেননি। সব হররের কেন ওই একই কারণ হতে হবে বলুন দেখি? এই বইও এর ব্যতিক্রম নয়। তবুও যেকারণে আগ্রহটা পাওয়া সেটা হলো, গল্পটা যেভাবে পাকানো হলো, তাতে অতি সুস্বাদু লাগলো। ভোগ গল্পটার যদি মূলবিষয় দেখি, এর সাথে মুহম্মদ আলমগীর তৈমুর স্যারের 'বংশালের বনলতা'র মিল রয়েছে। এখন হরর গল্পে তো আমরা মূল বিষয়বস্তু দেখতে যাইনা। দেখতে গেলে তো সব গল্পই এক! তবু ওই গল্পটার উদাহরণ টানছি গল্পের গঠনগত সাদৃশ্যের বর্ণণা করতে (আরে! পোস্ট করতে গিয়ে দেখি এই সাদৃশ্যের কথা আরও অনেকেই বলেছেন। মানে একই পৃষ্ঠায়ই আছি...)। একটা গল্পকে এভাবে স্তরে স্তরে সাজালে, সেটা উপভোগ্য হবেই। এই সহজ বিষয়টা লেখকরা যদি একটু বুঝে ফেলতেন, যেকোনো এলিমেন্টের হরর গল্পকে তারা উপভোগ্য করাতে পারতেন। তা না করে শুধু অপদেবতা ঘাড় মটকে দেবে শীর্ষক প্লট বেড়ে দিলেই তা পাতে তোলা যাবেনা। ঠগীদের নিয়ে লেখা শোধ গল্পটাও ভালো। রক্তফলক ভালো লাগেনি বিশেষ। এখানে এসে লেখকও ভুলে গিয়েছিলেন বোধয় সিস্টেমটার কথা। যাহোক, ইনকুইজিশন এর সেটাপ ভালো। এটা হরর হয়েছে বলে মনে হয়না। তবে অতীত বর্তমান মিলে একটা ভালো টাইমলাইন ওয়ালা গল্প হয়েছে। উত্তেজনা, বর্ণণা, বিল্ডাপ সবই দারুণ। শুধু আমার মনে হয়েছে এত ব্যপ্তি প্রয়োজনই ছিলনা। এত ব্যপ্তি ঘটেছে কারণ লেখক ইন ডেপথ বলতে চেয়েছেন। বোঝা যায় এমন বিষয় আবার বুঝতে ভালো লাগেনা। এটাই হয়ে গেছে সমস্যা। যেকারণে চর্বিতচর্বন লেগেছে। তবু ভালো। আধুনিক 'তন্ত্র-মন্ত্র'র ঘটনাই বটে।
নিজের আগ্রহের খাতিরে এই বইয়ের "ভোগ" গল্পটি পড়লাম। তাও সদ্য "অলাতচক্র" শেষ করেই। গল্পটি শীঘ্রই ওটিটিতে সিরিজ হিসেবে অভিনীত হবে, "এই দেশেতেই " থাকা নায়ক আর "কয়লাখনি" সমৃদ্ধ পরিচালকের দ্বারা। সমগ্র গল্পটা বুনিপোচিত ভিএফেক্সের কথা মাথায় রেখেই লেখা বলে বোধ হয়েছে। আর থ্রিল তো বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সততার মতোই বিদ্যমান এই গল্পে! পুনশ্চ: বাক্যের মাঝে হুট করে "বরকারার" এর মতো শব্দ খুবই শ্রুতিকটু লাগে।
৩ দিবো ভাবসিলাম; 'শোধ' আর বাকি দুইটা যা-ও মোটামুটি রিডেবল ছিলো, 'ইনকুইজিশন' গল্পটার কারণে রেটিং বাড়বে তো দূরের কথা, আরো কমায় দিলাম। আর ওই, "ভালোবাসা সবচেয়ে বড় তন্ত্র" না মুড়িঘণ্ট ডায়লগটা! কেন?! তন্ত্রমন্ত্রের বইয়ে সিনেমা কেন?
লেখক এর সাথে পরিচয় রেডিও মির্চির ' Sunday Suspense' er মাধ্যমে। সেখানে, ' ভোগ ' গল্পটি অনবদ্য ভাবে পরিবেশন করা হয়েছিল, এবং তা শোনা মাত্র, লেখকের কাজ সম্বন্ধে জানতে উৎসুক হয়ে পড়ি। জানতে পারি লেখক এর ' এবং ইনকুইজিশন ' বইটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই বছর বইমেলায় বইটি প্রাপ্ত করার বাদ, পড়ার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। ইতিমধ্যে, বই এর অন্তর্গত আর একটি গল্প ' শোধ ' শোনবার সৌভাগ্য হয়েছিল,( সৌজন্যে অবশ্যই রেডিও মির্চি), এবং সেটি আমার ভোগ এর থেকেও আরো ভালো লেগেছিলো। কিছুদিন আগে পড়া শেষ করা সত্বেও, রিভিউ করার সময় পাইনি। Covid-19 এর প্রকোপে, লকডাউন চলার দরুন, ভাবলাম শুভ কাজে আর বিলম্ব করাটা ঠিক না! প্রথমেই বলে দি, বইটি পড়ে আমি বেশ তৃপ্তি পেয়েছি। তারানাথ তান্ত্রিক বাদে তন্ত্র নিয়ে এত সুগঠিত লেখা, বাংলায় বোধহয় আর হয়নি। অবশ্য, শুধু তন্ত্র কেনো, লেখক যে ইতিহাস ও বেশ পছন্দ করেন, তা তার গল্পের প্রেক্ষাপট নির্বাচন দেখলেই আন্দাজ করা যায়। বইটিতে তিনটে বড়গল্প এবং একটি ছোট মাপের উপন্যাস আছে। গল্পগুলোর মধ্যে আমার একান্ত পছন্দের গল্প, শোধ। ঠগী এবং তন্ত্র নিয়ে লেখা, এক অনবদ্য গল্প। লেখক ডিয়ালেক্ট চেঞ্জ এ পারদর্শী, এই গল্পটি তার প্রমাণ। পরের গল্প রক্তফলক, নৃশংসতায় পরিপূর্ণ হওয়া সত্বেও,একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বক্তব্য রাখতে সক্ষম। গল্পের শেষ বড়ই সস্তি দায়ক। ভোগ হয়ত এই বইএর সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্প। অন্য গল্পগুলোর তুলনায় ইতিহাস এর ভূমিকা কম বলে হয়তো, গল্পটি অনেক লোকের কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য। যদি ভয়ের উপাদানের ও কথা বলি, সেটি এই গল্পেই সবচেয়ে বেশি উপস্থিত। অবশেষে, বলবো ইনকুইজিশনের কথা। লেখক এখানে তিনটি সময়কালে সমান্তরাল ভাবে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ঐতিহাসিক সময়কাল গুলো খুবই উপভোগ করেছি, কিন্তু তৎকালীন সময়কালের ট্র্যাক যেন গল্পের গতি হনন করেছে। গল্পগুলোর তুলনায় তাই এটি কোথাও যেনো আমার কাছে একটু পিছিয়ে থাকবে।
অভীক বাবুর কাছ থেকে আরো অনেক ভালো ভালো লেখার প্রত্যাশা রাখলাম।
ঠাকুরের / বংশের / কুড়িয়ে পাওয়া অভিশাপ, পুরোনো গল্প বলার জন্যে এক বুড়ো বা বুড়ি, হিরোর ফ্যামিলির কেউ নেই গো, কিন্তু ছেলে আমাদের ভালো, টিপিন করতে বা চা খেতে গিয়ে আগমবাবুর আবির্ভাব, এই নাও মাদুলি, একসাথে দু-তিনটে জাতিস্মর বা ইতিহাসের রিপিট টেলিকাস্ট, হিরোর চুলেও কিসসু হল না, যাহ মাদুলি আর বাবাজি ভ্যানিশ,
- এই হল অভিক বাবু। নতুন বই এলে এই ফর্দর সাথে লাল পেন্সিল নিয়ে বসে মিলিয়ে নেবেন।
অভীক সরকারের এই পাঠকপ্রিয় বইটি গতবছর পড়েছি। ইদানীং ভূতের গল্পে ভূত কম আর তন্ত্রমন্ত্র বেশি। আমি হয়তো সেকেলে রুচির মানুষ। তাই এত বেশি তন্ত্রমন্ত্রের বাড়াবাড়ি এবং গল্প পড়তে বসে সাধারণ জ্ঞানের ক্লাস করতে ভালো না৷ এ কারণে বইটা যতটা উপভোগ করা উচিত ততখানি হয়নি। তবু বলব 'ভোগ' ও 'শোধ'-এর মতো গল্প পড়তে যে-কোনো পাঠকের ভালোই লাগবে।
তন্ত্র বিষয়ে প্রায় নিরক্ষরই বলা চলে আমাকে। বৌদ্ধমতের বিভেদ (মহা, হীন, বজ্র, সহজিয়া), সনাতন ও বৌদ্ধমতের বিভিন্ন তান্ত্রিক দেবদেবীর বর্ণনা (হেরুক, বজ্রবারাহী, ডামরী), খ্রিস্টান/পাশ্চাত্য মতের তন্ত্র (গটস্কলথ গ্রিমি নিকুলসন, হোলার চার্চ, রওডস্কিনা, বিভিন্ন গ্রিমোয়ার) ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ না হোক অন্তত একটা আবছা জ্ঞান দেয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। এসকল বিষয়ে আরো পড়াশোনা করার ইচ্ছা ���ইলো।
সৌমিক দের কালীগুণিন কিংবা সৌভিক চক্রবর্তীর নিরেন ভাদুড়ির পর অভিক সরকারের 'এবং ইনকুইজিশন' আমার পড়া হাল আমলের তন্ত্র সংক্রান্ত তৃতীয় হরর/থ্রিলার এবং নিঃসন্দেহে এটি ভয়াবহতম।
'ভোগ' গল্পটি বেশ ভয় লেগেছে। বিশেষ করে ডামরীর উপস্থিতি। শেষটায় নীল আলোর স্ফটিকের রহস্য উদ্ধার হয়নি তাই একটু আফসোস রয়ে গেছে। তৃতীয় গল্প 'রক্তফলক' ও বেশ। বৌদ্ধ ধর্মে বিভেদের ইতিহাস ও বৌদ্ধমতের ত��ন্ত্রিক দেবদেবী নিয়ে চমৎকার একটা বর্ণনা আছে।
শ্রেষ্ঠ লেখাটি হলো 'ইনকুইজিশন'। নভেলাটি দুবাংলাতেই বেশ বিখ্যাত হয়েছে। পড়ে বুঝতে পেরেছি কেনো হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীর গোয়া থেকে অধুনা আফগানিস্তান, হাল আমলের পর্তুগাল থেকে অষ্টাদশ শতকের আইসল্যান্ড হয়ে সর্বশেষে কাহিনী ফিরে গেছে পুনরায় সেই গোয়ার অখ্যাত গ্রামটিতে। খুবই মাথা খাটিয়ে লেখা। এক কাল/স্থান থেকে আরেক কাল/স্থানে দৃশ্যপটের পরিবর্তন যেকোনো বিখ্যাত থ্রিলার মুভির গতিপথকে মনে করিয়ে দেয়। তবে পর্তুগীজদের নৃশংসতা ও কমান্ডো অপারেশানের খুঁটিনাটি বিবরণ বাহুল্য বলে মনে হয়েছে।
এবং অবশ্যই শেষদৃশ্যে জগজ্জননীর আবির্ভাবে গায়ে কাঁটা দিয়েছিলো!
'শোধ' সে তুলনায় একটু কম ভালো লেগেছে। তন্ত্রের চাইতে ইতিহাসের কচকচানি বেশি। অতিরিক্ত ফার্সি আর মারাঠি (ঠগীদের ভাষা) শব্দের উৎপাত বিরক্ত লেগেছে। দস্তরখান, সুরাহি, শিরাজি, বেশক, বেতাজ আর ফুরকদেনা, কাসসি, তুপোনি, ঝিরণী, খোনতুরি, ব্রিনজার, ধুনকির মাঝে পড়ে হাঁসফাস করেছি। এই এক এক দৃশ্যে এক এক ভাষা ব্যবহারের উৎপাত ছাড়া বাকিটুকু ভালোই লেগেছে। এন্ডিং টা আরেকটু সময় দিয়ে করা যেত।
পুরো বইজুড়ে 'কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ' চরিত্রটি কমন। খোঁজ নিয়ে জানলাম এ নামে একজন বাস্তবের তন্ত্রজ্ঞই ছিলেন। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন কালীসাধক শ্রী রামপ্রসাদ সেনের দীক্ষাগুরু ও বাংলায় দেবী কালিকার পূজিতা মূর্তিরূপের উদ্ভাবক।
সবমিলিয়ে চমৎকার অভিজ্ঞতা। লেখকের বাকি বইগুলোও পড়ার ইচ্ছা রইলো। রেটিং ৫ এ ৫।
এক কথায় অসাধারণ একটি বই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এর প্রত্যেকটি পৃষ্ঠার রস আস্বাদন করেছি বলতে পারেন। ৪টা গল্পই অসাধারণ। এর মধ্যে 'ভোগ' ও 'এবং ইনকুইজিশন' এই দু'টো গল্প আরো বেশি ভাল্লেগেছে। হাইলি রেকমেন্ডেড বই।
a "must read" for all the Bengali book readers. Avik Sarkar has done a very good and thorough research on Buddhism and Hindu mystical ritual and history. The book is really captivating. I absolutely enjoyed reading this book.
অনেকদিন থেকেই প্রচুর প্রশংসা আর ভালো ভালো কথা শুনছিলাম এই বইটার সম্পর্কে।স্বাভাবিক ভাবেই একটা আগ্রহ তৈরি হয়ে গেছিলো বইটার প্রতি।তাই বইমেলার উইশলিস্টের বেশ ওপরের দিকেই ছিলো এই বইটি। যে কটা বই কিনেছিলাম তার মধ্যে এটা দিয়েই শুরু করেছিলাম এবারের বইমেলা পরবর্তী পাঠ। আমি মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেব। বইটা ভালো, এবং বেশ অন্যরকম, কিন্তু যতটা hyped কেমন কিছু লাগলো না। চারটি বেশ বড় মাপের গল্পের সঙ্কলন এই বইটি।এবং genre টা যাকে আজকাল বলা হয় 'ডার্ক ফ্যান্টাসি'! (শুনলেই আমার কেমন ডার্ক চকলেট মনে পড়ে যায়!) তন্ত্র সাধনা নিয়ে রীতিমতো চর্চা করে লেখা এ বই, লেখকের খাটুনি আর পড়াশোনার গভীরতা ভালোই বোঝা যায়। ভিন্ন ভিন্ন সময়কাল আর ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র বেশ মুন্সীয়ানার সাথে ব্যবহার করেছেন লেখক, সাথে আছে সেই ভিন্ন সময়কালের সুন্দর মেলবন্ধন। চারটি গল্পের একটাই যোগসূত্র, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। এই চরিত্রটি সব দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে চারটি গল্পেই মুশকিল আসান। এবং ব্যাপারটা একেবারেই আরোপিত লাগেনা। বইটির সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখলাম ইনি আসলেই এক ঐতিহাসিক চরিত্র, অন্তত নামটা তো বটেই, কাজেকর্মে মিল থাক বা না থাক। চারটি গল্পের মধ্যে প্রথম গল্প 'শোধ' আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, ব্রিটিশরাজের পটভূমিকায় লেখা ঠগীদের নিয়ে এই কাহিনীর সাথে তন্ত্রসাধনার দারুণ এক ককটেল পরিবেশন করেছেন লেখক, শুধু এই গল্পটিতে হিন্দী/উর্দু শব্দ/শব্দবন্ধের অত্যধিক ব্যবহার একটু বিরক্তির সৃষ্টি করছিল। বাকি গল্পগুলোর পটভূমিকা বেশ আকর্ষণীয় হলেও সত্যি বলতে কি আমার ততোটা ভালো লাগেনি। 'শোধ' গল্পটিতে অতিপ্রাকৃত উপস্থিত, কিন্তু খুব সূক্ষভাবে। অন্য গল্পগুলিতে তাদের উপস্থিতি আমার বড্ড বেশি প্রকট লেগেছে। এটাই বোধহয় বাকি গল্পগুলো অতোটা ভালো না লাগার কারণ। তাও বলবো লেখককে অনেক অভিনন্দন টানটান উত্তেজনাকর একটি বই পাঠককে উপহার দেওয়ার জন্য। এমন একটি বই যা বাংলায় এই genre-টির প্রতি পাঠককুলের আকর্ষণ নতুনভাবে তৈরি করে দিয়েছে।
বইটির নাম 'এবং ইনকুইজিশন'। এতে রয়েছে চারটি গল্প। চতুর্থটি অপেক্ষাকৃত বড়ো, প্রায় উপন্যাসসম। গল্পগুলির নাম -
শোধ রক্তফলক ভোগ ইনকুইজিশন
সবগুলোই তন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে লেখা, যেগুলোর মুল সারমর্ম হল - 'ভালোবাসাই হল সবথেকে বড় তন্ত্র, সবথেকে বড় জাদু'।
তন্ত্রের গল্প এত পরিমাণে লেখা হয়েছে যে বর্তমানে একঘেঁয়ে হয়ে উঠেছে। তবে অভীক সরকারের একটি গুণ হলো যে উনি একটি সাধারণ গল্পকে এতো সুন্দর ভাবে রহস্যমন্ডিত করে লিখতে পারেন যে সেই সাধারণ গল্পটি হয়ে ওঠে একটি টানটান থ্রিলার। তার কাউড়িবুড়ির মন্দির বইটিতেও এই টানটান ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছিলাম, তাই এই বইটি পড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বইটির জন্য যে তিনি অঢেল পড়াশুনা এবং রিসার্চ করেছেন, তা একদম স্পষ্ট। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে যে শুধু পড়াশুনা করেছেন তা নয়, বইটিতে পাওয়া খ্রিস্টান ধর্মের স্যাটানিক কাল্টের অনেক তথ্য এবং তাদের সাথে চার্চের বিরোধের ঘটনা বলে দেয় যে তার রিসার্চ কতদূর অবধি পৌঁছেছিল। এর সাথে রয়েছে তন্ত্রের ইতিহাসের ওপর একটি প্রবন্ধ। এবং গল্��গুলোতে নন-লিনিয়ার স্টোরীটেলিং এর দারুন প্রয়োগ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এটি সত্যিই একটি অনবদ্য বই।
এই বইটি তিনটি ভয়াবহ এবং একই সাথে তথ্যসমৃদ্ধ গল্প ও একটি উপন্যাসের সমাহার। প্রাচীন ভারতের তন্ত্রচর্চাকে এমনই অন্যভাবে পেশ করে লেখা যা বইটি না পড়লে বোঝা সম্ভব না। প্রতিটি গল্পেই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশের এন্ট্রিতে রোমহর্ষক থ্রিল পাবেন একদম দাবি করে বলতে পারি। প্রথম গল্প শোধ প্রচণ্ড ভয়োদ্রেককারী। মুহূর্তে মুহূর্তে গল্পের বিভৎসতায় কেঁপে উঠবেন। দ্বিতীয় গল্প রক্তফলকও একই শুধু মাত্রা আলাদা। তবে পড়ে খুব শান্তি আসবে গল্পের শেষ দেখে। তৃতীয় গল্প ভোগ এর আগেই Sunday suspense এ হয়েছে। তবে পড়ে যা বুঝলাম টা হল গল্পের বিভৎসতা কে কমিয়ে সুরুচিকর বানিয়ে পেশ করা হয়েছিল। গল্পের ৬০% হাড়কাঁপানো ভয় বাদই পড়ে গেছে। চতুর্থ গল্প বা উপন্যাস বলা ভালো ইনকুইজিশন বইয়ের সিংহ ভাগ জুড়ে আছে। ( ১২৮-২৩৮) গল্পটি খুবই ভালো। পড়ে যেমন ভয়ে কাঁপবেন তেমনই আবেগে আকুল হয়ে উঠবেন। ২৩৬-২৩৮ পাতা তে পৌঁছে তো পাতার লেখা গুলো ঝাপসা লাগছিল। চোখে কিছু পড়ে গেছিল সম্ভবত।