গঞ্জাপা
গঞ্জাপা (ওড়িয়া: ଗଞ୍ଜପା) হল ভারতীয় রাজ্য ওড়িশা থেকে প্রচলিত খেলার তাস।[১] ট্রিক-টেকিং তাস খেলাতেও এর উল্লেখ করা যায়, যেখানে এটি ব্যবহার করা হয়। বৃত্তাকার আকৃতিতে আঁকা পটচিত্র তাস দিয়ে খেলা হয়। ১৬ শতকে উদ্ভূত, গঞ্জাপা হল ওড়িয়া সমাজের পুরুষ সদস্যদের জন্য একটি বিনোদনমূলক খেলা, প্রাথমিকভাবে গ্রামবাসীরা, রাজা এবং তাঁর দরবার সদস্যরা খেলেন। গঞ্জাপাকে "চারিরঙ্গী" (৪টি রঙের তাস), "আটরঙ্গী" (৮টি রঙের তাস), "দশরঙ্গী" (১০টি রঙের তাস), "বারোরঙ্গী" (১২টি রঙের তাস), "চোদ্দরঙ্গী" (১৪টি রঙের তাস) এবং "ষোলরঙ্গী" (১৬ রঙের তাস) হিসেবে খেলা হয়। ফার্সি তাস ক্রীড়া গঞ্জিফা দ্বারা প্রভাবিত এই খেলার বৈচিত্রটি "মুঘল গঞ্জিফা" নামে পরিচিত। খেলাটি ওড়িশার পুরী এবং গঞ্জাম জেলায় জনপ্রিয়।[২][৩] অতীতে ওড়িশার আপেক্ষিক বিচ্ছিন্নতার ফলে, গঞ্জাপা ভারতের বাকি অংশে পাওয়া গঞ্জিফা থেকে খুব আলাদাভাবে বিকশিত হয়েছিল।[৪] ওড়িশায় এখন পর্যন্ত গঞ্জিফা খেলোয়াড় এবং নির্মাতাদের বৃহত্তম সম্প্রদায় রয়েছে।
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]ওড়িয়া শব্দ গঞ্জাপা "গঞ্জিফা" ( ফার্সি শব্দ গঞ্জিফা থেকে উদ্ভূত)[৫]-র সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়, সেটি মুঘল সম্রাটদের জনপ্রিয় খেলা ছিল।[২]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]ক্রীড়াটি সম্পর্কে প্রথম লিখিত দলিলটি মামলুক সময়ের ১৩৯৯ - ১৪১২ সালের, যেখানে মামলুকের সেনা আধিকারিক কাঞ্জাফা খেলে মুক্তিপণ জয়ের কথা উল্লেখ করে। ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদে মামলুক তাসের একটি সেট রয়েছে।[৬] গঞ্জিফার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট বাবরের শাসনকালে।[৫]
শিল্পকর্ম
[সম্পাদনা]গঞ্জাপা তাসে ব্যবহৃত শিল্পকর্ম হল পটচিত্র চিত্রকলা।[৭] পটচিত্রের মোটিফ এবং নকশায় নৃত্যশিল্পী ও অন্যান্য লোকেদের আলংকারিক উপস্থাপনা থাকে। এছাড়াও রামায়ণ, হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর দশাবতার, এবং হিন্দু পুরাণের অন্যান্য দেবতাদের গোল তাসে আঁকা হয়েছে। কারুকাজে সর্বদাই ঐতিহ্যবাহী ওড়িশা শিল্প থাকে এবং ওড়িশায় অঞ্চল থেকে অঞ্চলান্তরে এবং সম্প্রদায় থেকে সম্প্রদায়ান্তরে পরিবর্তিত হয়।[৫] গঞ্জামের গঞ্জাপা শিল্পকর্ম পুরীর শিল্পকর্ম থেকে ভিন্ন।[৩]
ওড়িশার গঞ্জাপা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে পাওয়া গঞ্জিফা থেকে বেশ আলাদা হয়।[৮] মোগল গঞ্জাপাতে, স্যুট-চিহ্নগুলি এখন অত্যন্ত শৈল্পিক এবং বিমূর্ত। দশাবতার গঞ্জিফাতে মাত্র ১০টি স্যুট রয়েছে তবে খেলাটিকে আরও চ্যালেঞ্জিং করতে এর গঞ্জাপা সমতুল্যে ১২, ১৬, ২০ বা ২৪টি স্যুট থাকতে পারে। রামায়ণের ধরনটি বর্তমানে ওড়িশার জন্য অনন্য এবং সম্ভবত বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও স্যুট-প্রতীক হিসাবে পাখি থাকে, এটি পর্যটকদের কাছে বাজারজাত করা একটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক আবিষ্কার।[৪]
তাস তৈরি
[সম্পাদনা]তাস তৈরির পদ্ধতি পটচিত্রের মতো। তেঁতুলের বীজ পিষে তৈরি আঠা স্তরে স্তরে কাপড়ে লাগিয়ে শুকোনো হয়। বৃত্তাকার আকৃতির তাসগুলি তারপর ফাঁপা লোহার চোঙ ব্যবহার করে খোদাই করা হয়। একটি তাস তৈরি করতে দুটি বৃত্তাকার পাত একসাথে যুক্ত করা হয়। লাক্ষা দিয়ে তৈরি প্রাকৃতিক রং শুকানোর পর, চুনাপাথর (সাদা রঙের জন্য), কয়লা-কার্বন (কালোর জন্য) এবং তেঁতুল (হলুদ রঙের জন্য) ব্যবহার করা হয় চিত্র আঁকার জন্য।[৫]
বৈচিত্র
[সম্পাদনা]গঞ্জাপাকে "চারিরঙ্গী" (তাসের প্যাকেটে ৪টি রঙের তাস বা ৪টি স্যুট), " আটরঙ্গী " (৮টি রঙের তাস),[১] "দশরঙ্গী " (১০টি রঙের তাস), "বারোরঙ্গী " (১২টি রঙের তাস) "চোদ্দরঙ্গী " (১৪টি রঙের তাস) এবং "ষোলরঙ্গী " (১৬টি রঙের তাস) হিসেবে খেলা হয়। প্রতিটি রঙে ১২টি করে তাস থাকে, যেমন একটি "চারিরঙ্গী গঞ্জপা"-এ ৪৮টি তাস থাকে, সাধারণ তাস খেলার মতোই, "আটরঙ্গী গঞ্জপাতে ৯৬টি তাস থাকে[২][৫] প্রতিটি রঙ একটি অনন্য পশ্চাদপট রঙ দ্বারা স্বীকৃত। প্রতিটি স্যুটে ১০টি সংখ্যাযুক্ত তাস (১ - ১০) এবং একটি রাজা ও একটি উজির থাকে। রাজার মান সর্বোচ্চ, তার পরে উজির এবং তারপরে সংখ্যাসূচক ক্রমটি ধাপে ধাপে নামে। রাজার তাস তার একটি চিত্র আছে, পা হাঁটুতে ভাঁজ করে বসার ভঙ্গিতে ("চৌকা মাদি বসা" নামে পরিচিত)। উজিরের তাসে উজির দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে। এছাড়াও রাজাকে ঘোড়ায় চড়ে এবং উজিরকে ঘোড়াত চড়েও দেখা যায়। কিছু তাসে দুই মাথা বিশিষ্ট রাজা এবং এক মাথা বিশিষ্ট উজির রয়েছে। পটচিত্র থেকে নেওয়া বিশেষ মানুষের মাথা এবং চারটি ভিন্ন প্রাণীর চারটি পা সহ কাল্পনিক চিত্রগুলিও তাসে দেখা যায়।[৯]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Singha, Minati (২২ মে ২০১৪)। "Ganjapa lost in the mists of time"। Times of India। সংগ্রহের তারিখ ৮ নভেম্বর ২০১৪।
- ↑ ক খ গ Panda, Namita। "Days numbered for Ganjapa cards"। Telegraph। নভেম্বর ৮, ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ নভেম্বর ২০১৪।
- ↑ ক খ Das, Sib Kumar। "A unique pack of cards"। Hindu। সংগ্রহের তারিখ ৮ নভেম্বর ২০১৪।
- ↑ ক খ Mann, Sylvia (১৯৯০)। All Cards on the Table। Deutsches Spielkarten-Museum। পৃষ্ঠা 184–192।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Jena, Monalisa (২০০১-০৭-০১)। "Playing cards of yore"। The Hindu। ৮ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ নভেম্বর ২০১৪।
- ↑ Nandagopal, Dr.Choodamani। "Ganjifa – The Indian Playing Cards"। Aventure। ৮ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ নভেম্বর ২০১৪।
- ↑ Samantaray, Prafulla Kumar। "Patta Chitra - It's [sic] Past and Present" (পিডিএফ): 50। ৯ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ নভেম্বর ২০১৪।
- ↑ Hopewell, Jeff (২০০৪)। "Ganjifa: The Traditional Cards of India"। Asian Games: The Art of Contest। Asia Society। পৃষ্ঠা 248।
- ↑ "GANJAPA playing cards"। RIA/CE। Raghurajpur International Art/Culture Exchange। ১০ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ নভেম্বর ২০১৪।