কুতুবুদ্দিন আইবেক
কুতুবুদ্দিন আইবেক | |
---|---|
সুলতান | |
রাজত্ব | ২৫ জুন ১২০৬ – ১২১০ |
পূর্বসূরি | মুহাম্মাদ ঘুরি |
উত্তরসূরি | আরাম শাহ |
জন্ম | তুর্কিস্তান |
মৃত্যু | ১২১০ দিল্লী সালতানাত |
সমাধি | |
ধর্ম | ইসলাম |
কুতুবউদ্দিন আইবেক (ফার্সি/উর্দু: قطب الدین ایبک) মধ্যযুগীয় ভারতের একজন তুর্কি শাসক ছিলেন, যিনি দিল্লির প্রথম সুলতান এবং দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সুলতান হিসেবে ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র চার বছর শাসন করেন। দানশীলতার জন্য তাকে ‘লাখবখশ’ বলা হত। ১২১০ সালে পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রাথমিক জীবন
[সম্পাদনা]কুতুবুদ্দিন মধ্য এশিয়ার কোনো এক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন; তার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন তুর্কি[১] শিশুকালেই তাকে দাস (গোলাম) হিসেবে বিক্রি করা হয়।[২] তাকে ইরানের খোরাসান অঞ্চলের[৩] নিসাপুরের প্রধান কাজী সাহেব কিনে নেন। কাজী তাকে তার নিজের সন্তানের মত ভালবাসতেন এবং আইবেককে তিনি ভাল শিক্ষা দিয়েছিলেন, তিনি আইবেককে ফার্সি এবং আরবি ভাষায় দক্ষ করে তোলেন।[৪] তিনি আইবেককে তীর এবং অশ্বচালনায়ও প্রশিক্ষণ দেন। আইবেকের প্রভুর মৃত্যুর পরে প্রভুর ছেলে আইবেককে আবারও এক দাস বণিকের কাছে বিক্রি করে দেন। কুতুবুদ্দিনকে এবার কিনে নেন গজনির গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ ঘুরি। তিনি মুহাম্মদ ঘুরির কাছে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রিয় পাত্র হয়ে উঠে এবং মুহাম্মদ ঘুরি তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। এবং মুহাম্মদ ঘুরির সহচর হিসেবে নিযুক্ত হন।[৫]
তার হাতের একটি আঙ্গুল কাটা ছিল ভাগ্যদোষে তিনি দাসে পরিণত হন।[৫] কুতুবউদ্দিন আইবেক মোহাম্মদ ঘুরির প্রধান সেনাপতি তাজ উদ্দিন ইলদুচে কন্যাকে বিবাহ করেন।[৬] কুতুবুদ্দিনের ভগিনীকে নাসিরুদ্দিন কোবাঁচার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। আইবেকের কন্যা এর সঙ্গে তুর্কি দাস সেনাপতি ইলতুৎমিশের বিবাহ হয়।[৫]
ঘুরি সুলতানের অধীনে
[সম্পাদনা]চাহামাদের বিরুদ্ধে অভিযান.
[সম্পাদনা]আইবেক ঘুরি সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনাপতি ছিলেন, যিনি চাহামান শাসক তৃতীয় পৃথ্বীরাজ বাহিনীর দ্বারা ভারতের তরাইনের প্রথম যুদ্ধ পরাজিত হয়েছিলেন। তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে ঘুরি সেনারা বিজয় লাভ করে এবং এই যুদ্ধে ঘুরি সৈন্যদের নেতৃত্বে ছিলেন আইবেক। তারাইনে তাঁর বিজয়ের পরে মুইজ আদ-দীন পূর্বের চাহামানা অঞ্চল আইবাকের কাছে অর্পণ করেন, যাকে কুহরম (বর্তমান ভারতের পাঞ্জাবের ঘুরম) এ স্থাপন করা হয়।পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র চতুর্থ গোবিন্দরাজকে আইবেক ঘুরি সামান্ত রাজা নিযুক্ত করেন। এর কিছুকাল পরে, পৃথ্বীরাজার ভাই হরিরাজা রণথম্বোর দুর্গ আক্রমণ করে, যা আইবেক তাঁর অধস্তন কাওয়ামুল মুলকের অধীনে রেখেছিলেন।আইবেক রান্থম্বরে আক্রমণের মাধ্যমে হরিরাজকে রথ্থম্বোর তথা পূর্বের চাহমন রাজধানী আজমির থেকে বিতাড়িত করেন।[৭]
দোয়াবে প্রাথমিক বিজয়
[সম্পাদনা]জাতওয়ানকে পরাজিত করার পরে আইবেক কুহরাম ফিরে আসেন এবং গঙ্গা-যমুনা দোয়াব আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।[৮]১১৯২ সালে তিনি মেরান, বরণ (আধুনিক বুলন্দশহর) -এর নিয়ন্ত্রণ নেন, সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে গহাদাবাল রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।১১৯২ সালে তিনি দিল্লিরও নিয়ন্ত্রণ নেন এবং যেখানে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় তোমারা শাসককে রেখে যান। পরবর্তীতে ১১৯৩ সালে তোমারা শাসককে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য পদচ্যুত করেন এবং দিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেন।
গহাদাবলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
[সম্পাদনা]গহাদাবল রাজত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ১১৯৪ সালে সুলতান মুইজ আদ-দীন ভারতে আসেন।[৯][৩]আইবাক ইজদ্দীন হোসেন ইবনে খারমিলকে সাথে নিয়ে চান্দাওয়ার যুদ্ধে তাঁর সেনাবাহিনীর ভ্যানগার্ডকে নেতৃত্ব দেন, যার ফলশ্রুতিতে গহাদাবালা রাজা জয়চন্দ্রের পরাজয় ঘটে।যদিও ঘুরিরা গহাদাবাল রাজ্যের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে পারেনি তবে এই বিজয় তাকে এই অঞ্চলের অনেক জায়গায় সামরিক ঘাটি স্থাপনের সুযোগ করে দেয়।[১]
অন্যান্য সামরিক অভিযানসমূহ
[সম্পাদনা]চান্দাওয়ারে বিজয়ের পরে আইবেক কোয়েলে তাঁর অবস্থান সুদৃঢ় করার দিকে মনোনিবেশ করেন।[১০] ১১৯৫-৯৬ সালের দিকে বায়ানার ভাটি শাসক কুমারপালাকে পরাজিত করার সময় গজনি থেকে ভারতে ফিরে আসেন মুয়িজ আদ-দ্বীন। এরপরে তিনি গোয়ালিয়রের দিকে রওনা হন, সেখানে স্থানীয় পরিহর শাসক সল্লাখানা পাল তাঁর অধিনস্থতা স্বীকার করে নেয়। এদিকে, আজমিরের নিকটে বসবাসরত মের আদিবাসীরা ঘুরিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।দক্ষিণে গুজরাত শাসনকারী চৌলুক্য সমর্থিত মেসাররা এই অঞ্চলে আইবেকের নিয়ন্ত্রণের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ আবির্ভূত হয়।[১১] আইবেক তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে আজমিরে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে ঘুরি রাজধানী গজনী থেকে আজমির স্তানান্তর করা হলে মেসাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১১৯৭ সালে আইবেক আবু উপত্যকায় চৌলুক্যা সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে,এভাবে প্রায় দু'দশক আগে কাশাহাড়ার যুদ্ধে মু'আইজ-আদ-দ্বীনের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া হয়। এরপর আইবেকের সেনাবাহিনী চৌলুক্যের রাজধানী আনহিলওয়ারার দিকে যাত্রা করে। তাদের আগমনে রাজা দ্বিতীয় ভীম শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। মিনহাজ আনহিলওয়ারে আইবেকের এই অভিযানকে "গুজরাত বিজয়" হিসাবে চিহ্নিত করেছেন,তবে এর ফলে গুজরাত ঘুরি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়নি।[১২] ষোড়শ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ ফিরিস্তার ভাষ্য মতে,আইবেক এই অঞ্চলে ঘুরি শক্তি সুসংহত রাখার জন্য একজন মুসলিম অফিসার নিয়োগ করেন, অপরদিকে ইবনে-ই আসির বর্ণনা করেছেন যে আইবাক নতুন দখলকৃত অঞ্চলটিকে হিন্দু সামান্ত রাজার অধীনে রেখেছিলেন।[১১]যাই হোক না কেন, এই অঞ্চলের ঘুরি নিয়ন্ত্রণ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, কিছু দিনের মধ্যে চৌলুকিয়রা তাদের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। ১১৯৭-৯৮ সালে, আইবেক বর্তমান উত্তর প্রদেশের বাডউন জয় করে এবং ঘুরি নিয়ন্ত্রণের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া পূর্ববর্তী গহাদাবালার রাজধানী বারাণসিরও পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে।১১৯৮-৯৯ সালে তিনি চান্দ্রবাল(সম্ভবত চান্দাবার)এবং কন্নৌজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেন।পরে তিনি সিরোহক(সম্ভবত রাজস্থানের আধুনিক সিরোহি) দখল করেন।পারসিয়ান কাহিনীকার ফখর-ই মুদব্বির এর মতে, আইবেক ১১৯৯-১২০০ সালে বর্তমান মধ্য প্রদেশে মালওয়াও জয় করেছিলেন,তবে অন্য কোন ঐতিহাসিকের বর্ণনাতে এ জাতীয় বিজয়ের কথার উল্লেখ পাওয়া যায় না, সুতরাং বলা যায় সম্ভবত আইবেক কেবল মালওয়া আক্রমণ করেছিল।১২০২ সালে, আইবেক মধ্য ভারতের চণ্ডেলা রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ কালিঞ্জর অবরোধ করেন।চণ্ডেলা শাসক পরমর্দী আইবেকের সাথে আলোচনা শুরু করেছিলেন, তবে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।[১১]এর কিছুদিনপর চণ্ডেলার মুখ্যমন্ত্রী অজয়দেব বিদ্রোহ করে বসে, কিন্তু ঘুরিরা দুর্গে জল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়।এরই অংশ হিসাবে চান্ডেলরা আজাইগড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।কালীঞ্জরের তাদের পূর্বকেন্দ্র, মহোবা এবং খাজুরাহোর দুর্গগুলি হাসান আরনালের নেতৃতে[১৩] ঘুরি নিয়ন্ত্রণে আসে।অপরদিকে, ঘুরি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি পূর্ব উত্তর প্রদেশ এবং বিহার অঞ্চলে ক্ষুদ্র গাদ্দাওয়ালার প্রধানদের পরাজিত করে ঘুরি সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটান।১২০৪ সালে, মুয়িজ আদ-দ্বীন আন্ডখুদে খোয়ারাজমিয়ানদের বিরুদ্ধে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়। আইবেক তাকে লাহোর অঞ্চলের খোকর প্রধানদের দ্বারা বিদ্রোহ দমন করতে সহায়তা করেন।১২০৬ সালের ১৫ই মার্চ মুইজ আদ-দ্বীনকে হত্যা করা হয়, বিভিন্ন উৎস তাঁর হত্যাকারী হিসেবে খোকারস বা ইসমাইলি সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করে।[১৪]
মুহাম্মদ ঘুরি মৃত্যু পরবর্তী সময়
[সম্পাদনা]ইতিহাসবিদ মিনহাজ-ই-সিরাজ রচিত তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থ মতে আইবেক দক্ষিণে উজাইনের সীমান্ত পর্যন্ত অঞ্চল অধিকার করেন। মিনহাজ-ই-সিরাজ এর ভাষ্যমতে ১২০৬ সালে সুলতান মু’জিয-আদ-দ্বীনের মৃত্যুর সময় ঘুরি সাম্রাজ্য ভারতের নিম্নে উল্লেখিত অঞ্চল গুলো শাসন করতঃ[১৫]
যদিও সকল অঞ্চলে ঘুরিদের প্রভাব সমান ছিল না। এর মধ্যে কয়েকটি জায়গায় যেমন গোয়ালিয়র এবং কালিন্জারে, ঘুরি নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে।
পূর্ব ভারতে
[সম্পাদনা]সুলতান মুইজ আদ-দ্বিনের রাজত্বকালে, পূর্ব ভারতের বিহার এবং বাংলা অঞ্চলের কিছু অংশ ঘুরি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির শাসনাধীন ছিল। ১২০৬ সালে দেবকোটে বখতিয়ার খিলজি তাঁর অধস্তন আলী মর্দান খিলজির হাতে হত্যার শিকার হন, একই সময় সুলতান মু’আইজ আদ-দ্বীনকেও হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে বখতিয়ারের আরেক অধস্তন মুহাম্মদ শিরান খিলজি, আলী মর্দানকে আটক করেন এবং পূর্ব ভারতের খলজীদের নেতা বনে যান। এদিকে আলী মর্দান পালিয়ে দিল্লি চলে যায়, সেখানে পৌঁছে আইবেককে খিলজি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে রাজি করায়। খিলজিদের উপর মু‘আইজ-আদ-দ্বিনের প্রভাব না থাকায়, আইবেকের পক্ষে এ ব্যাপারে করনীয় কিছুই ছিল না। তা সত্ত্বেও, তিনি তাঁর অধস্তন আওয়াদ এর গভর্নর কায়মাজ রুমিকে তৎকালীন বাংলার লাখনাউতে পাঠান এবং খিলজি আমিরদের থেকে উপযুক্ত ইকতা আদায়ের নির্দেশ প্রদান করেন। কাইমাজ রুমী বখতিয়ারের আরেক অধস্তন হুসামুদ্দিন ইওয়াজ খিলজির নিকট দেবকোটের ইকতার দায়িত্ব অর্পণ করেন। মুহাম্মদ শিরান এবং অন্যান্য খিলজি আমিরগণ এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারেনননি এবং দেবকোট আক্রমণ করেন। রুমি তাদের প্রতিহত করেন।পরবর্তীতে অপর এক সংঘর্ষে মুহাম্মদ শিরান মৃত্যুবরণ করেন।[১৬]
হিন্দুস্থানের শাসক হিসেবে পরিচিতি
[সম্পাদনা]হাসান নিজামির তাজুল মাআসির নামক গ্রন্থ থেকে উল্লেখ পাওয়া যায় যে, মুহাম্মাদ ঘুরি তারাইনের বিজয়ের পর আইবেক কে ভারতে তার প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত করেন।হাসান নিজামী এটাও উল্লেখ করেন যে কুহরাম ও সামানার ইয়ালাত(গভর্নরশিপ)আইবাকের উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। ফখর-ই মুদাব্বির নামে একজন সমসাময়িক ইতাহাসবিদের মতে, ১২০৬ সালে আইবেক খোখার বিদ্রোহ দমন করে গজনীতে ফিরে আসার পর, মুইজ আদ-দ্বীন তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় অঞ্চলগুলির ভাইসরয় নিযুক্ত করেন।এরই ধারাবাহিকতায় আইবেক পদোন্নতি লাভ করে মালিক এবং ক্রমান্বয়ে সুলতানের ভারতীয় অঞ্চলগুলির উত্তরাধিকারীতে পরিণত হন।ইতিহাসবিদ কে. এ. নিজামির মতে সুলতান মুইজ আদ-দ্বীন আইবেককে কখনই ভারতে তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে নিয়োগ করেননি, কূটনীতিক এবং সামরিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সুলতানের মৃত্যুর পরে দাস-সেনাপতি এই পদ অর্জন করেছিলেন।সুলতানের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু তাঁর তিন প্রধান সেনাপতি আইবেক, তাজ আল দ্বীনজিলদিজ এবং নাসির আদ দ্বীন কাবাচা কে ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দিয়েছিল।শেষ বছরগুলিতে, নানা কারণে সুলতান তাঁর পরিবার এবং সভাসদদের প্রতি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, এসময় কেবলমাত্র তাঁর দাসদের উপরই ভরসা ছিল।সুলতানের মৃত্যুর সময় আইবেকের সদর দফতর ছিল দিল্লিতে।লাহোরের নাগরিকরা তাকে সুলতানের মৃত্যুর পরে সার্বভৌম ক্ষমতা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে।এসময় তিনি তাঁর সদর দফতর লাহোরে স্থানান্তর করেন।১২০৬ সালের ২৫জুন তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে সিংহাসনে আরোহণ করেন, তবে সার্বভৌম শাসক হিসাবে তাঁর স্বীকৃতি ঘটেছিল ১২০৮-০৯ সালের পর।[১৭]
এদিকে, গজনী ও তার আশেপাশে সুলতানের দাসগণ ঘুরি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য যুদ্ধ করতে থাকে। এই দাস নেতারাই পরবর্তীতে আইবেকের ভাগ্নে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ কে সিংহাসনে আরোহণ করতে সহায়তা করেছিলেন। মাহমুদ যখন তাঁর অবস্থান সুদৃঢ় করেন, আইবেক ও অন্যান্য দাস শাসকগণ বিভিন্ন ঘুরি অঞ্চল শাসন এর কৌশল ও বিনিয়োগের জন্য তাঁর দরবারে দূত পাঠাতেন। কুতুবউদ্দিন আইবেকের শ্বশুর ইলদিজ, ভারতের ঘুরি নিয়ন্ত্রিত অঞ্ছলসমুহ শাসনের ইচ্ছা পোষণ করতেন। সুলতান মাহমুদ গজনভি তাকে গজনির শাসক নিযুক্ত করার পর পাঞ্জাবের দখল নিতে পাঞ্জাব আক্রমণ করেন।আইবেক তাঁকে প্রতিরোধ করে কুহিস্থানে ফিরে যেতে বাধ্য করেন এবং গজনীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেন।অতঃপর আইবেক তার প্রতিনিধি নিজামউদ্দিন মুহাম্মদকে ফিরুজ কুহে মাহমুদের সদর দফতরে প্রেরণ করেন,বিনিয়োগের জন্য তাঁর অনুরোধটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য। ১২০৮-০৯ সালের দিকে সুলতান মাহমুদ আইবেককে আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দুস্থানের শাসক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।তিনি এ সময় আইবেককে দাস থেকে করে দেন।মিনহাজের তাবাকাত-ই নাসিরীর মতে সুলতান মাহমুদ আইবেক কে "সুলতান" উপাধি দিয়েছিলেন,হাসান নিজামি ও তাঁকে সুলতান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[১৭]নিজামি এটাও দাবী করেন যে, আইবেকের নামে খুতবা পাঠ করা হত এবং তাঁর নামে মুদ্রারও প্রচলন ছিল। কিন্তু অন্য কোন উৎসে তাঁর এই দাবীর পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়না।[১৭] মিনহাজের মতে,এক সময় আইবেক আত্মতুষ্ট হয়ে ওঠে, গজনীতে আনন্দ বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়।এমন পরিস্থিতিতে গজনীর জনগণ তাঁকে শহর থেকে উচ্ছেদ করার জন্য ইলদিস কে আমন্ত্রণ জানায়। ইলদিসের আগমন সংবাদ শুনে আইবেক বিচলিত হয়ে পড়ে এবং সাঙ্গ ই সুরখ এর পাহাড়ি পথ ধরে শহর ত্যাগ করে। ইলদিসের আক্রমণ থেকে রাজ্যগুলো বাঁচাতে আইবেক তাঁর রাজধানী লাহোরে স্তানান্তর করেন।[১৭]
শহর ত্যাগের আইবেকের সঙ্গী আলী মরদান খিলজি কে ইলদিস গ্রেফতার করে বন্দী করে রাখে।কিন্তু তিনি কৌশলে মুক্ত হয়ে ভারতে ফিরে আসেন।আইবেক তাঁকে বাংলার লখউনতিতে শাসক হিসেবে প্রেরন করেন।এভাবেই আলী মর্দান পূর্ব ভারতে আইবেক শাসিত রাজ্যগুলির গভর্নর হন এবং পুরো অঞ্চল তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।[১৮]
মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার
[সম্পাদনা]ভারতের শাসক হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরে আইবেক নতুন রাজ্য জয় করার পরিবর্তে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলি একত্রীকরনের দিকে মনোনিবেশ করেন। ১২১০ সালে তিনি চৌগান (পোলোর একটি রূপ) খেলার সময় ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।সমসাময়িক সকল ইতিহাসবিদগণই আইবেক কে অনুগত, উদার, সাহসী এবং ন্যায়বান শাসক হিসাবে প্রশংসা করেছেন।মিনহাজের ভাষ্যমতে, দানশীলতার কারণে তাঁকে "লাখ-বখশ" উপাধি দেয়া হয়েছিল এবং তিনি আক্ষরিক অর্থে লক্ষ তামার মুদ্রা দান করতেন। ফখর-ই মুদাব্বির বলেছেন যে, আইবেকের নিয়ন্ত্রণে থাকা তুর্কি, ঘুরি, খুরসানী, খলজিস এবং হিন্দুস্তানী কোন সৈন্যই কখনও কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে কোন কিছু আদায়ের সাহস করেনি। ষোড়শ শতাব্দীর মুঘল কালজয়ী আবু-ফজল আইবেকের সুলতান মুআজ আদ-দ্বীন মুহাম্মদ ঘুরি কে "নির্দোষের রক্তপাতের জন্য" সমালোচনা করেছেন, তবে আইবেকের প্রশংসা করে বলেন যে "তিনি (আইবেক) ভাল এবং মহৎ কিছু অর্জন করেছেন"।সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে,"তৎকালীন আইবেক"শব্দটি উদার ব্যক্তিদের বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হত; কালজয়ী ইতিহাসবিদ ফিরিস্তার লেখায় এই কথার সত্যতার প্রমাণ মেলে।[১৯]
আকস্মিক মৃত্যুর কারণে আইবেক কাউকে তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যেতে পারেননি।তাঁর মৃত্যুর পরে, লাহোরে অবস্থিত তুর্কি অফিসাররা (মালেক এবং আমির)আরম শাহকে তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে নিযুক্ত করেন।সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে আরম শাহের জীবন সম্পর্কে কোনও বিবরণ পাওয়া যায় না।একটি তত্ত্ব অনুসারে তিনি আইবাকের পুত্র ছিলেন, তবে এই তত্ত্ব সত্য হওয়ার সম্ভাবনা কম।আরম শাহ আট মাসের বেশি সময় শাসন করেছিলেন,এ সময়ে বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নররা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় কিছু তুর্কি সেনাপ্রধানরা আইবেকের প্রাক্তন বিশিষ্ট দাস সেনাপতি শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ কে ক্ষমতা গ্রহণের অনুরোধ জানায়।১১৯৭ সালে আনহিলওয়ারা বিজয়ের পরে আইবেক ইলতুতমিশ কে কিনেছিলেন।মিনহাজের মতে, পরবর্তী শাসক হিসাবে আইবেকের নজর প্রথম থেকেই ইলতুতমিশের দিকে ছিল; তিনি ইলতুতমিশকে তাঁর পুত্র বলে ডাকতেন এবং তাকে বাদুনের ইকতা (ইসলামিক কর আদায়কারী অধিকার) দিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ইলতুতমিশকে আরম শাহের উত্তরসূরি হিসাবে নিযুক্ত করা হয় এবং আইবেকের কন্যার সাথে তাঁর বিবাহ দেয়া হয়। আরম শাহ ইলতুতমিশ কে সিংহাসন থেকে সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং এক যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। ইলতুতমিশ বিদ্রোহী গভর্নরদের পরাজিত করে নড়বড়ে দিল্লী সালতানাত কে শক্তিশালী করে তোলেন। ইলতুতমিশের পরে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এবং পরবর্তীতে তার অধীনস্থ গিয়াসউদ্দিন বলবন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। এই শাসনকাল ইতিহাসে মামলুক সালতানাত বা দাস শাসনকাল নামে পরিচিত। যদিও আক্ষরিক অর্থে কেবল আইবেক, বলবান ও ইলতুতমিশ সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে দাস ছিল। অন্যান্য শাসকরা তাদের জীবনকালের কোন পর্যায়েই দাস ছিল না।[২০]
বর্তমানে তাঁর সমাধিটি লাহোরের আনারকলিতে অবস্থিত। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগ আইবেকের সমাধিটি সুলাতানি যুগের অনুকরণে পুনর্নির্মাণ করে। বর্তমান অবস্থার আগে সুলতানের সমাধিটি চারপাশে বাড়ি ঘর বেষ্টিত একটি সাধারণ সমাধির মত ছিল। এই স্থানে আদৌ কোন সমাধি ছিল কিনা তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে বিতর্ক আছে ( যদিও কিছু ইতিহাসবিদদের মতে এই স্থানে মারবেল পাথরের গুম্বুজ বিশিষ্ট কবরের অস্তিত্ব ছিল যা শিখদের দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়)।
ব্যক্তিগত জীবন
[সম্পাদনা]মিহাজের তাবকাত-ই-নাসিরীর কয়েকটি পাণ্ডুলিপিতে আইবেকের উত্তরসূরি আরাম শাহ কে বিন আইবাক ("আইবাকের পুত্র") সম্বোধন করা হয়েছে। তবে এটি আনাড়ি লেখকের দ্বারা করা ভুল কাজ হতে পারে, যেমন আলাউদ্দিন আতা মালিক-ই-জুওয়ানির তারিক-ই-জাহান-গুষাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে আইবেকের কোনও পুত্র ছিল না। মিনহাজ আইবেকের ৩টি কন্যা সন্তানের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম জনের সাথে মুলতানের ঘুরি গভর্নর নাসির আদ-দ্বীন কাবাছার সাথে বিয়ে হয়। তার মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় কন্যার বিয়েও হয়েছিল কাবাছের সাথে। তৃতীয় জন আইবাকের দাস ইলতুৎমিশের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল, যিনি দিল্লির সিংহাসনে আরম শাহের স্থলে বসেন।[২১]
ধর্ম
[সম্পাদনা]কাহিনীকার হাসান নিজামী যিনি আইবেকের রাজত্বকালে নিশাপুর থেকে দিল্লিতে চলে এসেছিলেন, আইবেককে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে উল্লেখ করেন। নিজামী দাবি করেন যে আইবেকের নির্দেশে হিন্দু মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরির করা হত, যেমন স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ দিল্লির কুতুব মিনার কমপ্লেক্স এবং আজমিরের আধাই দীন কা ঝোঁপরা। তবে তাঁর দাবি গুলো সন্দেহজনক। এক পর্যায়ে আইবেকের সেনাবাহিনীতে হিন্দু সৈন্যদের নিয়োগ শুরু করে। মেরুতের অবরোধে (১১৯২ সাল) তাঁর সেনাবাহিনীতে হিন্দু সৈন্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে জানা যায়। একইভাবে, ১২০৬ সালে গজনীতে "হিন্দুস্তান বাহিনী" (হাশাম-ই হিন্দুস্তান) এ হিন্দু নেতারা ("রানা" এবং "ঠাকুর") অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সাংস্কৃতিক অবদান
[সম্পাদনা]আইবেকের রাজত্বকালে দিল্লির কুতুব মিনার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। আইবেক সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ফখর-ই মুদাব্বির যিনি আদাব আল-হারব - যুদ্ধের শিষ্টাচার রচনা করেছিলেন - বইটি আইবেক কে উৎসর্গ করেছিলেন। হাসান নিজামির তাজুল-মাআসিরের রচনা, যা ইলতুতমিশের রাজত্বকালে সমাপ্ত হয়েছিল, সম্ভবত আইবাকের রাজত্বকালেই শুরু হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Peter Jackson 2003, পৃ. 24।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 191।
- ↑ ক খ Peter Jackson 1982, পৃ. 546।
- ↑ Fluent in Persian and Arabic (page 2)
- ↑ ক খ গ K. A. Nizami 1992, পৃ. 204।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 205।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 164।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 162।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 166।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 168।
- ↑ ক খ গ K. A. Nizami 1992, পৃ. 169।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 167।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 170।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 171।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 201।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 202।
- ↑ ক খ গ ঘ K. A. Nizami 1992, পৃ. 203।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 197।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 197-198।
- ↑ K. A. Nizami 1992, পৃ. 198-199।
- ↑ Shah, Dr Syed Talha (২০১৮-১২-২৩)। "HISTORY: THE HERITAGE OF THE SLAVE SULTAN"। DAWN.COM (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২৪।
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- Irfan Habib (১৯৮২)। "Non-Agricultural Production and Urban Economy"। Tapan Raychaudhuri; Irfan Habib। The Cambridge Economic History of India। 1, c. 1200 - c. 1750। Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-22692-9।
- K. A. Nizami (১৯৯২)। "The Early Turkish Sultans of Delhi"। Mohammad Habib; Khaliq Ahmad Nizami। A Comprehensive History of India: The Delhi Sultanat (A.D. 1206-1526)। 5 (Second সংস্করণ)। The Indian History Congress / People's Publishing House। ওসিএলসি 31870180।
- Peter Jackson (২০০৩)। The Delhi Sultanate: A Political and Military History। Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-54329-3।
- Peter Jackson (১৯৮২)। "Kutb Al-Din Aybak"। C. E. Bosworth; E. van Donzel; Charles Pellat। The Encyclopaedia of Islam। 5: Supplement (New সংস্করণ)। Leiden: E. J. Brill। আইএসবিএন 90-04-06167-3।